মেঘলা আকাশ। তুমুল বৃষ্টি। আচমকাই বিদ্যুতের ঝলকানি, আর প্রবল বাজ পড়ার শব্দে কান ঝালাপালা হয়ে যায়। পশ্চিমবঙ্গ শুধু নয়, দেশের বিভিন্ন রাজ্যে ইদানীং বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা সাঙ্ঘাতিকভাবে বেড়েছে। জয়পুরে ওয়াচ টাওয়ারে সেলফি তুলতে গিয়ে বজ্রপাতে মৃত্যু হয়েছে ১১ জনের, উত্তরপ্রদেশে ৪০ জনের মৃত্যুর খবর মিলেছে। ভারতে বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা গত দুই থেকে তিন বছরে অনেকটাই বেড়েছে। কেন এই ঘন ঘন বাজ পড়ে, বিদ্যুত্‍স্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যু হয় কীভাবে, কতটা সাবধান থাকতে হবে, এইসব নিয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন আবহবিদ ও পরিবেশ বিজ্ঞানীরা। আইএমডি-র হিসেব বলছে, ২০১৯-২০২০ সাল অবধি বজ্রপাতের ঘটনা সাঙ্ঘাতিকভাবে বেড়েছে ভারতে। এই সময়ের মধ্যে চার লাখের বেশি বজ্রপাতের ঘটনা ঘটেছে। বিশেষ করে উত্তর-পূর্ব ভারত ও ছোট নাগপুর মালভূমি অঞ্চল বজ্রপাতের হটস্পট হয়ে উঠেছে। ২০১৯ সালে বজ্রপাতে ভারতে মৃত্যু হয়েছে ২,৮৭৬ জনের, গত বছর ২,৩৫৭ জনের। এর মধ্যে মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি বিহারে প্রায় ৪০০ জন, মধ্যপ্রদেশে ৪০০ জন, ঝাড়খণ্ডে ৩৩৪ জন ও উত্তরপ্রদেশে ৩২১ জন। পশ্চিমবঙ্গে বজ্রপাতে মৃত্যু বেড়েছে। গত বুধবার বাংলায় মুর্শিদাবাদ ও হুগলি তে মোট ২৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত বছর ৭১ জন মারা যান এ রাজ্যে। দেশে বছরে প্রায় আড়াই হাজার মৃত্যু হয়েছে বজ্রপাতে।

বজ্রপাতের সময় কীভাবে সাবধান থাকবেন? কী কী বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে

  • প্রচণ্ড ঝড় ও বিদ্যুতের ঝলকানি শুরু হলে সাবধান হতে হবে। যদি বাড়ির বাইরে বা কোনও ফাঁকা জায়গায় থাকেন, তাহলে দ্রুত বাড়ি ফেরার চেষ্টা করুন। না হলে কোনও নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় নিন। কোনও কংক্রিটের আচ্ছাদনের নীচে আশ্রয় নেওয়াই ভাল, কোনও গাছ বা টাওয়ারের নীচে নয়।
  • বজ্রপাতের সময় গাছপালা, উঁচু টাওয়ার বা বৈদ্যুতিক খুঁটির ধারেকাছে থাকা বিপজ্জনক। খোলা ছাদে থাকবেন না, বারান্দার গ্রিল ধরে না দাঁড়ানোই ভাল।
  • বাজ পড়ার সময় যে কোনও ধাতব বস্তু, সিঁড়ির রেলিং, জানলার গ্রিল, পাইপ ইত্যাদির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলুন।
  • বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি, গ্যাজেট, বিদ্যুত্‍ সংযোগ রয়েছে এমন জিনিসপত্র না ছোঁয়াই ভাল। কোনওরকম বৈদ্যুতিক তারে হাত দেবেন না। এই সময় মোবাইল ব্যবহার করতেও বারণ করেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে বাড়ির বাইরে থাকলে বাজ পড়ার সময় মোবাইলে কথা বলা বিপজ্জনক হতে পারে। বাড়িতে থাকলে ফোন চার্জে বসিয়ে কথা বলবেন না।
  • বজ্রপাতের সময় কোনও নদী, পুকুর বা জলাশয়ে থাকাও ঠিক নয়। বিশেষজ্ঞরা বলেন, খোলা জায়গায় বা মাঠের মাঝখানে থাকার সময় যদি বাজ পড়া শুরু হয়, তাহলে মাথা নীচু করে বসে বা শুয়ে পড়ুন।
  • চামড়ার ভেজা জুতো বা খালি পায়ে থাকা বিপজ্জনক। রাস্তায় বের হতে হলে রাবারের জুতো পরাই ভাল।
  • প্রতিটি বাড়ি বা উঁচু বিল্ডিংয়ে বজ্র নিরোধক ব্যবস্থা অবশ্যই রাখতে হবে। তা না থাকলে বজ্রপাতের সময় এক ঘরে সবাই মিলে থাকবেন না। খোলা জায়গায় থাকলেও পারস্পরিক দূরত্ব রাখতে হবে।
  • বজ্রপাতের সময় কী করা উচিত, সেই সম্পর্কে রাজ্য সরকার প্রচার শুরু করেছে। বিশেষ করে যাঁরা বাড়ির বাইরে কাজ করেন, তাঁদের ঝুঁকি বেশি থাকে। চাষের জমিতে যাঁরা কাজ করেন তাঁদের মৃত্যু বেশি হয়, তাই জেলায় জেলায় এখন সচেতনতার প্রচার শুরু হয়েছে।

বজ্রপাতের কারণ কী?

বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ যদি বেশি হয় এবং চারপাশে পরিবেশের তাপমাত্রা যদি বাড়ে, তাহলে সেই আর্দ্র ও উত্তপ্ত বায়ু দ্রুতগতিতে ঠান্ডা হয়ে বজ্রগর্ভ মেঘ তৈরি করে। দেখা যায়, বায়ুমণ্ডলের উপরের অংশের তাপমাত্রা নীচের তুলনায় কম থাকে। তাই এই বজ্রগর্ভ মেঘের প্রবাহ নীচ থেকে উপরের দিকে হয়, যাকে বলে থান্ডার ক্লাউড। এই মেঘের মধ্যে জলীয় বাষ্পের বাড়তে থাকলে তাদের মধ্যে আলোড়ন তৈরি হয়, ফলে ছোট ছোট জলকণা, তুষারকণা তৈরি হয়। এদের মধ্যে সংঘর্ষের ফলেই বৈদ্যুতিক আধান তৈরি হয়। যখন জলীয় বাষ্পের পরিমাণ পাঁচ মিলিমিটার ছাড়িয়ে যায় যখন জলের অনুগুলো আলাদা হয়ে তড়িত্‍ ধণাত্মক ও ঋণাত্মক আধান তৈরি করে। ফলে বিদ্যুত্‍ প্রবাহ তৈরি হয়। আকাশে বিদ্যুতের ঝলকানি দেখা যায়। সাধারণত, বায়ু তড়িত্‍ পরবহণ করতে পারে না। তাহলে বজ্রপাত হয় কী করে? বিজ্ঞানীরা বলছেন, বজ্রগর্ভ মেঘের নীচের অংশে জলীয় বাষ্প ও তুষারকণার পরিমাণ বেশি থাকে। সেখানে জলকণায় সংঘর্ষ বেশি হয়, তুলনায় উপরের দিকে কম হয়। ফলে মেঘের নীচের দিকে নেগেটিভ চার্জের পরিমাণ বেশি থাকে, আর উপরের দিকে থাকে পজিটিভ চার্জ। এই দুই বিপরীতধর্মী চার্জের প্রতিক্রিয়ায় শক্তিশালী বিদ্যুত্‍ ক্ষেত্র তৈরি করে। তবে এই বিদ্যুত্‍ ক্ষেত্র মেঘের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। এখন বজ্রপাত তখনই হয় যখন মেঘের মধ্যে এই তড়িত্‍ ঋণাত্মক বা ইলেকট্রন চার্জের পরিমাণ বেড়ে যায়, বিপরীতে মাটিতে তড়িত্‍ ধণাত্মক চার্জ জমা হয়। বজ্রগর্ভ মেঘ ও মাটিতে তৈরি হওয়া দুই বিপরীত ধর্মী চার্জের পরিমাণ বাড়লে মাঝের বাতাসের বাধা অতিক্রম করে একটি লাইন তৈরি হয়, যাকে বলে স্টেপড লিডার। মেঘে যে শক্তিশালী ক্ষেত্র তৈরি হয় তার প্রতি ইঞ্চিতে প্রায় ১০ হাজার ভোল্ট বিদ্যুত্‍ শক্তি থাকে। ফলে চারপাশের বাতাসও আয়নিত হয়ে যায়। ফলে এই পথেই মেঘ থেকে বিদ্যুত্‍ শক্তি মাটিতে নেমে আসে। তখন আমরা বলি বজ্রপাত হয়েছে। সাধারণত গাছপালা, উঁচু বাড়ি, টাওয়ার ইত্যাদি বেয়ে মাটি থেকে তড়িত্‍ ধণাত্মক চার্জ ওপরে উঠে মেঘের তড়িত্‍ ঋণাত্মক চার্জের সঙ্গে ওই লাইন তৈরি করে। তাই দেখা যায়, গাছের ওপর বা টাওয়ারের ওপর অথবা ফাঁকা জায়গায় বজ্রপাতের ঘটনা বেশি ঘটে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান সময়ে বাতাসে দূষণ, ধূলিকণার পরিমাণ বেড়েছে। সেই সঙ্গেই বেড়েছে তাপমাত্রা। এই দুই কারণের জন্য বজ্রগর্ভ মেঘ তৈরি হচ্ছে বেশি। বাতাসে জলীয় বাষ্প ও ধূলিকণার পরিমাণ বাড়ছে, তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে, ফলে অনেক বেশি বাতাস নীচ থেকে উপরে উঠে থান্ডার ক্লাউড তৈরি করছে। ফলে মেঘ থেকে ভূমিতে বজ্রপাতের পরিমাণ বাড়ছে।

বজ্রপাতে কীভাবে মৃত্যু হয়?

মার্কিন ন্যাশনাল ওয়েদার সার্ভিসের (NWS) রিপোর্ট বলছে, বজ্রপাতের সময় ১০ কোটি থেকে ১০০ কোটি ভোল্ট শক্তি তৈরি হয়। যেখানে বজ্রপাত হয় তার চারপাশের বাতাসের তাপমাত্রা ১০ হাজার থেকে ৩০ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছে যায়। এই প্রচণ্ড তাপ ও শক্তির মাঝে কোনও মানুষ বা প্রাণী চলে এলে, সঙ্গে সঙ্গেই মৃত্যু হয়। এই জন্য বাজ পড়ার সময় গাছের নীচে বা উঁচু টাওয়ার বা বাড়ির নীচে থাকতে নিষেধ করা হয়। ফাঁকা জায়গাতেও সরাসরি মেঘ থেকে ভূমিতে বিদ্যুত্‍ প্রবাহের লাইন তৈরি হয়, ফলে এইসব জায়গায় বিপদের ঝুঁকি অনেক বেশি। তাছাড়া ধাতব অংশ, বা বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের ধারেকাছেও থাকতে নিষেধ করেন বিশেষজ্ঞরা। যে কোনও ধাতব বস্তুতে তড়িত্‍ ক্ষেত্র তৈরি হয়ে বিপদ বাড়াতে পারে।
Share To:

kakdwip.com

Post A Comment:

0 comments so far,add yours