গত ২৭ অক্টোবর শ্রীনগরে জইশ-ই-মহম্মদের সমর্থনে পোস্টার দেখা যায়। তারপরই উত্তর প্রদেশের সাহারানপুর ও হরিয়ানার ফরিদাবাদে দুটি ভাড়াবাড়ি থেকে প্রায় ৩ হাজার কেজি বিস্ফোরক, পিস্তল, বোমার টাইমার, ব্যাটারি উদ্ধার হয়। আর সেই ভাড়া বাড়ি দুটি একজন ডাক্তারের।
চিকিৎসকরাই যখন জঙ্গি! হোয়াইট কলার টেররিজমের বীজ কোথায় পোঁতা?
ডাক্তাররা জঙ্গি হলেন কী করে?
চিকিৎসকদের ‘ভগবান’ বলা হয়, কারণ তাদের হাতে নির্ভর করে জীবন-মৃত্যু। কারোর জীবনে যেখানে ‘ঈশ্বর’ হয়ে ওঠেন কোনও চিকিৎসক, সেখানেই ১২টি পরিবারের কাছে আজ চিকিৎসকই ‘শয়তান’! কারণ দিল্লিতে লালকেল্লার কাছে সোমবার, ১০ নভেম্বর ভয়াবহ বিস্ফোরণ হয়, তার পিছনে হাত ছিল চিকিৎসকদেরই। বিস্ফোরণের সময় গাড়িতে ছিলেন ডঃ উমর। বিস্ফোরক উদ্ধার হয় আরেক চিকিৎসক, মুজাম্মিলের ভাড়া নেওয়া বাড়ি থেকে। নাম উঠে এসেছে ডঃ শাহিন নামক আরেক মহিলা চিকিৎসকের, যিনি ভারতে জইশের (Jaish-e-Muhammad) মহিলা শাখার প্রধান। দিল্লির এই বিস্ফোরণ চোখ খুলে দিয়েছে গোয়েন্দাদের যে সন্ত্রাস শুধুমাত্র সমাজের নিম্নস্তরের বা গরিব যুবদের মগজ ধোলাই করেই চালানো হয় না, বরং অতি উচ্চ-শিক্ষিতরাও সন্ত্রাসে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদত দিচ্ছেন। পেটে বিদ্যা-বুদ্ধি থাকার পরও কেন তারা সন্ত্রাসের পথ বেছে নিচ্ছেন?
গত সপ্তাহের গোড়াতেই ফরিদাবাদের ধাউজ গ্রামের একটি বাড়ি থেকে ৩ হাজার কেজি অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট উদ্ধার করা হয়। তারপরই সোমবার লাল কেল্লার কাছে ভয়াবহ বিস্ফোরণ হয়। উড়ে যায় পরপর গাড়ি, ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় দেহ। আহত বহু মানুষ। তদন্তে নেমেই জানা যায় যে এই বিস্ফোরণের পিছনে হাত রয়েছে চিকিৎসকদের। উঠে আসে “হোয়াইট কলার টেররিজম মডিউল” (White Collar Terrorism)। কী এই হোয়াইট কলার টেররিজম?
'আমরা তো কারও না কারও সার্ভেন্ট', কী ইঙ্গিত দিচ্ছেন স্বর্ণ ব্যবসায়ী খুনে ধৃতরা?
সন্ত্রাসবাদের নিশানা বরাবরই ছিল স্কুলছুট, বেকার বা হতদরিদ্র যুবরা। আজমল কাসব থেকে শুরু করে জম্মু-কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের রেকর্ড দেখলেই এই তথ্য স্পষ্ট হয়ে যাবে। তবে সবসময় যে গরিবদেরই প্রভাবিত করা, ধর্মের ভয় দেখিয়ে মগজধোলাই করা হয়, তা নয়। তাবড় ফিজিসিস্ট থেকে শুরু করে রসায়নের অধ্যাপক, এখন চিকিৎসকরাও এই সন্ত্রাসের মাথা হতে পারেন। আগে মাওবাদী শীর্ষনেতাদের শিক্ষাগত যোগ্যতাও এমনই নজরকাড়া ছিল।
দিল্লি বিস্ফোরণ কাণ্ডের আগের সপ্তাহে গ্রেফতার হয়েছিলেন ডঃ আদিল আহমেদ (২৭)। জম্মু-কাশ্মীরের অনন্তনাগে গভর্মেন্ট মেডিক্যাল কলেজের আলমারি থেকে উদ্ধার হয়েছিল একে-৪৭। তদন্তে জানা যায়, গত বছরের ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত তিনি এই হাসপাতালে কাজ করতেন।
গত ২৭ অক্টোবর শ্রীনগরে জইশ-ই-মহম্মদের সমর্থনে পোস্টার দেখা যায়। তারপরই উত্তর প্রদেশের সাহারানপুর ও হরিয়ানার ফরিদাবাদে দুটি ভাড়াবাড়ি থেকে প্রায় ৩ হাজার কেজি বিস্ফোরক, পিস্তল, বোমার টাইমার, ব্যাটারি উদ্ধার হয়। আর সেই ভাড়া বাড়ি দুটি একজন ডাক্তারের। ওই চিকিৎসকের নাম মুজাম্মিল শাকিল। তিনি জম্মু ও কাশ্মীরের বাসিন্দা। ফরিদাবাদে আল ফলাহ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের চিকিৎসক ছিলেন। জঙ্গি সংগঠন জইশ-ই মহম্মদের সঙ্গে তাঁর যোগসূত্র পাওয়া গিয়েছে।
এরপরে গ্রেফতার করা হয় ডঃ শাহিন শহিদকে। লখনউয়ের লালবাগের বাসিন্দা শাহিন। তিনিও আল ফালাহ ইউনিভার্সিটির চিকিৎসক। তাঁর গাড়ি থেকেও একে-৪৭ ও তাজা কার্তুজ উদ্ধার করা হয়। এই শাহিনের শিক্ষাকতা যোগ্যতা চমকে দেওয়ার মতো। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকে প্রথম, বিশ্ববিদ্যালয়েও দুর্দান্ত রেজাল্ট।
গত ৭ নভেম্বর গুজরাটের এটিএস হায়দরাবাদ থেকে আহমেদ মহিউদ্দিন সইদ নামক আরেকজনকে গ্রেফতার করে। ইনি আবার চিন থেকে এমবিবিএস করে এসেছেন। ক্যাস্টর বীজ থেকে রিচিন নামক এক বিষ তৈরি করছিলেন, যার এক ফোঁটাও প্রাণঘাতী। আহমেদ বেশ কয়েক মাস ধরে দিল্লির আজাদপুর মান্ডি, আহমেদাবাদের নারদা ফল বাজার, এমনকী লখনউয়ের আরএসএসের অফিস পর্যন্ত রেইকি করেছিলেন। তাঁর কাছ থেকেও বন্দুক, তাজা কার্তুজ, চার লিটার কাস্টর তেল উদ্ধার করা হয়।
এদের সকলের গ্রেফতারি একটাই প্রশ্ন তুলেছে যে অতি শিক্ষিতরাও সন্ত্রাসে জড়িয়ে পড়ছেন। তবে এই ঘটনা কিন্তু নতুন নয়, এর আগে ৯/১১ হামলায় যারা জড়িত ছিল, তারাও উচ্চশিক্ষিত ছিলেন। তারা সৌদি আরব ও মিশরের মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসেছিলেন। এরা সকলেই শিক্ষার জন্য বাড়ির বাইরে বা দেশের বাইরে গিয়েছিলেন। প্রধান চক্রী, মহম্মদ আত্তা কাইরো ইউনিভার্সিটি থেকে আর্কিটেকচার নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। এরপর হামবুর্গ থেকে আর্বান ডিজাইনে পোস্ট গ্রাজুয়েশন করেছিলেন। বাকি সদস্যরাও জার্মানি থেকে পড়াশোনা করেছিলেন।
আইসিসের যদি জঙ্গি মডিউল দেখা হয়, তাহলে দেখা যাবে তারা ব্রিটেন ও সুদান থেকে বহু মেডিক্যাল স্টুডেন্ট ও ফিজিসিয়ানদের নিয়োগ করেছিল। আইসিস প্রধান বাকর আল বাগদাদি ইসলামিক স্টাডিতে পিএইচডি করেছেন। আল কায়েদার সদস্য আয়মান আল জারদারি সার্জন, এমনকী ওসামা বিন লাদেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং করেছিলেন। তামিল এলটিটিই-রাও উচ্চ শিক্ষিত। তাই সন্ত্রাসবাদের বীজ যে শুধুমাত্র গরিব বা কম শিক্ষিতদের মধ্যে বপন করা যায়, তা নয়।
এর ব্যাখ্যা দিয়ে রাজনৈতিক সাইকোলজিস্ট ডঃ ফতালি মোগাদাম বলেছিলেন, মৌলবাদ বা উগ্রপন্থার উৎপত্তি কিন্তু শুধুমাত্র দারিদ্রতা বা অবহেলা থেকে হয় না। এটা তখনই কারোর মগজে ঢোকানো সম্ভব হয় যখন কেউ অপমানিত বোধ করেন, সামাজিকভাবে অবহেলিত বা শোষিত হন। বরং শিক্ষিতদের অনেক ক্ষেত্রে মগজধোলাই করা বেশি সহজ হয় কারণ তারা জীবনের অর্থ খোঁজেন। তখন হিংসা বা সন্ত্রাস তাদের মাথায় ধ্বংস নয়, বরং একটা উদ্দেশ্য হয়ে ওঠে।