কুতুব উদ্দিন আইবকের প্রাথমিক জীবন





কুতুবুদ্দিন মধ্য এশিয়ার কোনো এক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন; তার পূর্ব পুরুষেরা ছিলেন তুর্কি[১] শিশুকালেই তাকে দাস (গোলাম) হিসেবে বিক্রি করা হয়।[২] তাকে ইরানের খোরাসান অঞ্চলের[৩] নিসাপুরের প্রধান কাজী সাহেব কিনে নেন। কাজী তাকে তার নিজের সন্তানের মত ভালবাসতেন এবং আইবেককে তিনি ভাল শিক্ষা দিয়েছিলেন, তিনি আইবেককে ফার্সি এবং আরবি ভাষায় দক্ষ করে তোলেন।[৪] তিনি আইবেককে তীর এবং অশ্বচালনায়ও প্রশিক্ষণ দেন। আইবেকের প্রভুর মৃত্যুর পরে প্রভুর ছেলে আইবেককে আবারও এক দাস বণিকের কাছে বিক্রি করে দেন। কুতুবুদ্দিনকে এবার কিনে নেন গজনির গভর্নর জেনারেল মুহাম্মদ ঘুরি। তিনি মুহাম্মদ ঘুরির কাছে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই প্রিয় পাত্র হয়ে উঠে এবং মুহাম্মদ ঘুরি তাকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দেন। এবং মুহাম্মদ ঘুরির সহচর হিসেবে নিযুক্ত হন।[৫]

তার হাতের একটি আঙ্গুল কাটা ছিল ভাগ্যদোষে তিনি দাসে পরিণত হন।[৫] কুতুবউদ্দিন আইবেক মোহাম্মদ ঘুরির প্রধান সেনাপতি তাজ উদ্দিন ইলদুচে কন্যাকে বিবাহ করেন।[৬] কুতুবুদ্দিনের ভগিনীকে নাসিরুদ্দিন কোবাঁচার সঙ্গে বিবাহ দেওয়া হয়। আইবেকের কন্যা এর সঙ্গে তুর্কি দাস সেনাপতি ইলতুৎমিশের বিবাহ হয়।[৫]




   
             চাহামাদের বিরুদ্ধে অভিযান সম্পাদনা

আইবেক ঘুরি সেনাবাহিনীর অন্যতম সেনাপতি ছিলেন, যিনি চাহামান শাসক তৃতীয় পৃথ্বীরাজ বাহিনীর দ্বারা ভারতের তরাইনের প্রথম যুদ্ধ পরাজিত হয়েছিলেন। তারাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে ঘুরি সেনারা বিজয় লাভ করে এবং এই যুদ্ধে ঘুরি সৈন্যদের নেতৃত্বে ছিলেন আইবেক। তারাইনে তাঁর বিজয়ের পরে মুইজ আদ-দীন পূর্বের চাহামানা অঞ্চল আইবাকের কাছে অর্পণ করেন, যাকে কুহরম (বর্তমান ভারতের পাঞ্জাবের ঘুরম) এ স্থাপন করা হয়।পৃথ্বীরাজের মৃত্যুর পরে তাঁর পুত্র চতুর্থ গোবিন্দরাজকে আইবেক ঘুরি সামান্ত রাজা নিযুক্ত করেন। এর কিছুকাল পরে, পৃথ্বীরাজার ভাই হরিরাজা রণথম্বোর দুর্গ আক্রমণ করে, যা আইবেক তাঁর অধস্তন কাওয়ামুল মুলকের অধীনে রেখেছিলেন।আইবেক রান্থম্বরে আক্রমণের মাধ্যমে হরিরাজকে রথ্থম্বোর তথা পূর্বের চাহমন রাজধানী আজমির থেকে বিতাড়িত করেন।[৭]

             দোয়াবে প্রাথমিক বিজয় সম্পাদনা
জাতওয়ানকে পরাজিত করার পরে আইবেক কুহরাম ফিরে আসেন এবং গঙ্গা-যমুনা দোয়াব আক্রমণ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করেন।[৮]১১৯২ সালে তিনি মেরান, বরণ (আধুনিক বুলন্দশহর) -এর নিয়ন্ত্রণ নেন, সেখান থেকে পরবর্তী সময়ে গহাদাবাল রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন।১১৯২ সালে তিনি দিল্লিরও নিয়ন্ত্রণ নেন এবং যেখানে তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে স্থানীয় তোমারা শাসককে রেখে যান। পরবর্তীতে ১১৯৩ সালে তোমারা শাসককে রাষ্ট্রদ্রোহের জন্য পদচ্যুত করেন এবং দিল্লির সরাসরি নিয়ন্ত্রণ নেন।





           গহাদাবলাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ সম্পাদনা

গহাদাবল রাজত্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে ১১৯৪ সালে সুলতান মুইজ আদ-দীন ভারতে আসেন।[৯][৩]আইবাক ইজদ্দীন হোসেন ইবনে খারমিলকে সাথে নিয়ে চান্দাওয়ার যুদ্ধে তাঁর সেনাবাহিনীর ভ্যানগার্ডকে নেতৃত্ব দেন, যার ফলশ্রুতিতে গহাদাবালা রাজা জয়চন্দ্রের পরাজয় ঘটে।যদিও ঘুরিরা গহাদাবাল রাজ্যের উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ অর্জন করতে পারেনি তবে এই বিজয় তাকে এই অঞ্চলের অনেক জায়গায় সামরিক ঘাটি স্থাপনের সুযোগ করে দেয়।[১]

        অন্যান্য সামরিক অভিযানসমূহ সম্পাদনা

চান্দাওয়ারে বিজয়ের পরে আইবেক কোয়েলে তাঁর অবস্থান সুদৃঢ় করার দিকে মনোনিবেশ করেন।[১০] ১১৯৫-৯৬ সালের দিকে বায়ানার ভাটি শাসক কুমারপালাকে পরাজিত করার সময় গজনি থেকে ভারতে ফিরে আসেন মুয়িজ আদ-দ্বীন। এরপরে তিনি গোয়ালিয়রের দিকে রওনা হন, সেখানে স্থানীয় পরিহর শাসক সল্লাখানা পাল তাঁর অধিনস্থতা স্বীকার করে নেয়। এদিকে, আজমিরের নিকটে বসবাসরত মের আদিবাসীরা ঘুরিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে।দক্ষিণে গুজরাত শাসনকারী চৌলুক্য সমর্থিত মেসাররা এই অঞ্চলে আইবেকের নিয়ন্ত্রণের জন্য মারাত্মক হুমকি স্বরূপ আবির্ভূত হয়।[১১] আইবেক তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করলেও শেষ পর্যন্ত তাকে আজমিরে ফিরে যেতে বাধ্য করা হয়। পরবর্তীতে ঘুরি রাজধানী গজনী থেকে আজমির স্তানান্তর করা হলে মেসাররা পিছু হটতে বাধ্য হয়। ১১৯৭ সালে আইবেক আবু উপত্যকায় চৌলুক্যা সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে,এভাবে প্রায় দু'দশক আগে কাশাহাড়ার যুদ্ধে মু'আইজ-আদ-দ্বীনের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়া হয়। এরপর আইবেকের সেনাবাহিনী চৌলুক্যের রাজধানী আনহিলওয়ারার দিকে যাত্রা করে। তাদের আগমনে রাজা দ্বিতীয় ভীম শহর ছেড়ে পালিয়ে যায়। মিনহাজ আনহিলওয়ারে আইবেকের এই অভিযানকে "গুজরাট বিজয়" হিসাবে চিহ্নিত করেছেন,তবে এর ফলে গুজরাট ঘুরি সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়নি।[১২] ষোড়শ শতাব্দীর ইতিহাসবিদ ফিরিস্তার ভাষ্য মতে,আইবেক এই অঞ্চলে ঘুরি শক্তি সুসংহত রাখার জন্য একজন মুসলিম অফিসার নিয়োগ করেন, অপরদিকে ইবনে-ই আসির বর্ণনা করেছেন যে আইবাক নতুন দখলকৃত অঞ্চলটিকে হিন্দু সামান্ত রাজার অধীনে রেখেছিলেন।[১১]যাই হোক না কেন, এই অঞ্চলের ঘুরি নিয়ন্ত্রণ বেশি দিন স্থায়ী হয়নি, কিছু দিনের মধ্যে চৌলুকিয়রা তাদের রাজধানীর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পায়। ১১৯৭-৯৮ সালে, আইবেক বর্তমান উত্তর প্রদেশের বাডউন জয় করে এবং ঘুরি নিয়ন্ত্রণের হাতছাড়া হয়ে যাওয়া পূর্ববর্তী গহাদাবালার রাজধানী বারাণসিরও পুনরায় নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ফেলে।১১৯৮-৯৯ সালে তিনি চান্দ্রবাল(সম্ভবত চান্দাবার)এবং কন্নৌজের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ফেলেন।পরে তিনি সিরোহক(সম্ভবত রাজস্থানের আধুনিক সিরোহি) দখল করেন।পারসিয়ান কাহিনীকার ফখর-ই মুদব্বির এর মতে, আইবেক ১১৯৯-১২০০ সালে বর্তমান মধ্য প্রদেশে মালওয়াও জয় করেছিলেন,তবে অন্য কোন ঐতিহাসিকের বর্ণনাতে এ জাতীয় বিজয়ের কথার উল্লেখ পাওয়া যায় না, সুতরাং বলা যায় সম্ভবত আইবেক কেবল মালওয়া আক্রমণ করেছিল।১২০২ সালে, আইবেক মধ্য ভারতের চণ্ডেলা রাজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ দুর্গ কালিঞ্জর অবরোধ করেন।চণ্ডেলা শাসক পরমর্দী আইবেকের সাথে আলোচনা শুরু করেছিলেন, তবে চুক্তি চূড়ান্ত হওয়ার আগেই মৃত্যুবরণ করেন।[১১]এর কিছুদিনপর চণ্ডেলার মুখ্যমন্ত্রী অজয়দেব বিদ্রোহ করে বসে, কিন্তু ঘুরিরা দুর্গে জল সরবরাহ বন্ধ করে দিলে আলোচনায় বসতে বাধ্য হয়।এরই অংশ হিসাবে চান্ডেলরা আজাইগড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়।কালীঞ্জরের তাদের পূর্বকেন্দ্র, মহোবা এবং খাজুরাহোর দুর্গগুলি হাসান আরনালের নেতৃতে[১৩] ঘুরি নিয়ন্ত্রণে আসে।অপরদিকে, ঘুরি সেনাপতি বখতিয়ার খিলজি পূর্ব উত্তর প্রদেশ এবং বিহার অঞ্চলে ক্ষুদ্র গাদ্দাওয়ালার প্রধানদের পরাজিত করে ঘুরি সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণ ঘটান।১২০৪ সালে, মুয়িজ আদ-দ্বীন আন্ডখুদে খোয়ারাজমিয়ানদের বিরুদ্ধে পরাজয়ের মুখোমুখি হয়। আইবেক তাকে লাহোর অঞ্চলের খোকর প্রধানদের দ্বারা বিদ্রোহ দমন করতে সহায়তা করেন।১২০৬ সালের ১৫ই মার্চ মুইজ আদ-দ্বীনকে হত্যা করা হয়, বিভিন্ন উৎস তাঁর হত্যাকারী হিসেবে খোকারস বা ইসমাইলি সম্প্রদায়কে অভিযুক্ত করে।[১৪]




ব্যাক্তিগত জীবন    :-

মিহাজের তাবকাত-ই-নাসিরীর কয়েকটি পাণ্ডুলিপিতে আইবেকের উত্তরসূরি আরাম শাহ কে বিন আইবাক ("আইবাকের পুত্র") সম্বোধন করা হয়েছে। তবে এটি আনাড়ি লেখকের দ্বারা করা ভুল কাজ হতে পারে, যেমন আলাউদ্দিন আতা মালিক-ই-জুওয়ানির তারিক-ই-জাহান-গুষাতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে আইবেকের কোনও পুত্র ছিল না। মিনহাজ আইবেকের ৩টি কন্যা সন্তানের কথা উল্লেখ করেন। প্রথম জনের সাথে মুলতানের ঘুরি গভর্নর নাসির আদ-দ্বীন কাবাছার সাথে বিয়ে হয়। তার মৃত্যুর পরে দ্বিতীয় কন্যার বিয়েও হয়েছিল কাবাছের সাথে। তৃতীয় জন আইবাকের দাস ইলতুৎমিশের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল, যিনি দিল্লীর সিংহাসনে আরম শাহের স্থলে বসেন।[২১]


 কুতুব উদ্দিন আইবকের ধর্ম

আজমিরে আধাইদিনের ঝনপাড়া
কাহিনীকার হাসান নিজামী যিনি আইবেকের রাজত্বকালে নিশাপুর থেকে দিল্লিতে চলে এসেছিলেন, আইবেককে একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান হিসাবে উল্লেখ করেন। নিজামী দাবি করেন যে আইবেকের নির্দেশে হিন্দু মন্দির ভেঙে মসজিদ তৈরির করা হত, যেমন স্থাপত্যিক ধ্বংসাবশেষ দিল্লির কুতুব মিনার কমপ্লেক্স এবং আজমিরের আধাই দীন কা ঝোঁপরা। তবে তাঁর দাবি গুলো সন্দেহজনক। এক পর্যায়ে আইবেকের সেনাবাহিনীতে হিন্দু সৈন্যদের নিয়োগ শুরু করে। মেরুতের অবরোধে (১১৯২ সাল) তাঁর সেনাবাহিনীতে হিন্দু সৈন্যদের অন্তর্ভুক্ত করা হয় বলে জানা যায়। একইভাবে, ১২০৬ সালে গজনীতে "হিন্দুস্তান বাহিনী" (হাশাম-ই হিন্দুস্তান) এ হিন্দু নেতারা ("রানা" এবং "ঠাকুর") অন্তর্ভুক্ত ছিল।







সংক্ষিপ্ত বর্ণনা


কুতুবউদ্দীন আইবক বা কুৎবউদ্‌দীন আইবক (ফার্সি/উর্দু: قطب الدین ایبک) মধ্যযুগীয় ভারতের একজন তুর্কী শাসক ছিলেন, যিনি দিল্লির প্রথম সুলতান এবং দিল্লি সালতানাতের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি সুলতান হিসেবে ১২০৬ থেকে ১২১০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মাত্র চার বছর শাসন করেন। দানশীলতার জন্য তাকে ‘লাখবখশ’ বলা হত। ১২১০ সালে পোলো খেলার সময় ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেন




সব তথ্য সংগ্রহের সাহায্য - উইকিপিডিয়া / GOOGLE
Share To:

kakdwip.com

Post A Comment:

0 comments so far,add yours