হিমাদ্রি সরকার

 কে ফিরিয়ে দেবে ছ'টা বছর? সৎ মেয়ের উপর যৌন নিগ্রহের মতো গুরুতর অভিযোগ যাঁর বিরুদ্ধে? গ্রেপ্তারি এড়াতে কিছু দিন গা-ঢাকা দিয়েও থাকতে হয়েছে যাঁকে? তার পর আদালতে আত্মসমর্পণ করে চার বছর জেলেই কাটাতে হয়েছে যে ব্যক্তিকে? চার বছর হাজতে রেখে বিচারপ্রক্রিয়া চলার পর অবশেষে নাবালিকা সৎ মেয়ের শ্লীলতাহানির দায় থেকে তাঁকে অব্যাহতি দিয়ে নির্দোষ ঘোষণা করেছে আদালত। জেল থেকে মুক্তির পর তিনি প্রশ্ন তুলছেন, মিথ্যা অভিযোগে এই অপবাদ সইতে হলো কেন?

এখানেই শেষ নয়। বছর ছয়েক আগে তাঁর বিরুদ্ধে সৎ মেয়েকে শ্লীলতাহানির অভিযোগ তুলেছিলেন তাঁর স্ত্রীই। চার বছর শুনানির পর আদালত মিথ্যা অভিযোগ করার দায়ে কারাদণ্ডের নির্দেশ দিয়েছে সেই স্ত্রীকে। বুধবার আলিপুরের দ্বিতীয় অতিরিক্ত জেলা জজ উমেশ সিং অভিযোগকারিণীকে মিথ্যা অভিযোগ করার জন্য তিন মাসের কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে আরও এক মাসের কারাদণ্ডের নির্দেশ দিয়েছেন। মামলা চলাকালীন অভিযোগকারিণীর মেয়েকে অন্তর্বর্তী ক্ষতিপূরণ হিসাবে যে দু'লক্ষ টাকা দেওয়া হয়েছিল, তাও ফেরত দিতে বলা হয়েছে।

কিন্তু এই অভিযোগের ভিত্তিতে যাঁকে অপমান-গঞ্জনা সইতে হয়েছে, চার বছর কাটাতে হয়েছে কারান্তরালে? তাঁর তরফে আইনজীবী শিউলি সাউ বৃহস্পতিবার জানিয়েছেন, আদালত তাঁকে ৪০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দিয়েছে। আইনজীবীর কথায়, 'আমার মক্কেল চার্জ গঠনের দিনেও আদালতে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, তিনি নির্দোষ। বিচার প্রক্রিয়া শেষে সেটাই প্রমাণ হলো। এই ঘটনার সূত্র ধরে আমাদের একটাই বক্তব্য, পুলিশ যেন এই ধরনের অভিযোগ পেলে ঠিক ভাবে তদন্ত করে চার্জশিট দেয়। তা না-হলে যাঁর জীবন থেকে এতগুলো বছর চলে গেল, তা কেউ ফিরিয়ে দিতে পারে না।'



ঘটনার সূত্রপাত ২০১৫-এর ২৩ জুলাই। দক্ষিণ শহরতলির ধপধপি রেললাইন লাগোয়া বস্তির বাসিন্দা স্বামী অভিযুক্ত, অভিযোগকারিণী স্ত্রী ও তাঁর মেয়ে। স্বামীর বিরুদ্ধেই মেয়ের যৌন নির্যাতনের অভিযোগ দায়ের করেন স্ত্রী। বারুইপুর জিআরপি সেইমতো শিশুদের উপর যৌন নির্যাতন প্রতিরোধ আইনে (POCSO) মামলা রুজু করে। ঘটনার পর কিছুদিন গ্রেপ্তারি এড়াতে গা-ঢাকা দিয়েছিলেন স্বামী। অবশেষে আইনজীবীর পরামর্শে তিনি ২০১৬-তে আদালতে আত্মসমর্পণ করেন তিনি। রেলপুলিশ POCSO আইনেই তাঁর বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়। অভিযুক্তকে হেফাজতে রেখেই শুরু হয় বিচার প্রক্রিয়া। কিন্তু নিগৃহীতা কিশোরীর মেডিক্যাল রিপোর্ট, সাক্ষীদের বয়ান ও অন্যান্য যেসব তথ্যপ্রমাণ পুলিশ পেশ করে, তা অভিযোগ প্রমাণের পক্ষে যথেষ্ট ছিল না বলে মনে করেছে আদালত। শুধু তা-ই নয়, অভিযোগকারিণীই পুলিশে মিথ্যা অভিযোগ করেছেন বলেও আদালত মনে করে। এর পরই আদালত এই দৃষ্টান্তমূলক সাজার নির্দেশ দেয়। আদালতের নির্দেশের ভিত্তিতে এদিনই জেল থেকে মুক্তি পেয়েছেন পেশায় দিনমজুর, অভিযুক্ত সৎ বাবা। তিনি বলছেন, 'আমি বারবার পুলিশকে বলেছিলাম, আমি নির্দোষ। তার পরেও এতদিন জেল খাটলাম। আদালত শেষ পর্যন্ত আমাকে নির্দোষ বলে ঘোষণা করেছে- এটাই আমার কাছে অনেক।'

আদালতের এমন নির্দেশ নজিরবিহীন বলে মনে করেন আইনজীবী অনির্বাণ গুহঠাকুরতাও। তিনি বলেন, 'আদালতের এমন নির্দেশের নজির খুব বেশি আছে বলে মনে হয় না। দৃষ্টান্তমূলক এই সাজার নির্দেশকে কুর্নিশ জানাই। যৌন নিগ্রহ বা POCSO-র মিথ্যা মামলাগুলির জেরেই অনেক সময় আসল নিগৃহীতা বা অভিযোগকারিণীর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। তাই কাউকে ফাঁসানোর জন্য POCSO-র ধারায় অভিযোগ আনায় আদালত যে সাজা দিয়েছে, তাতে মিথ্যা মামলা করার আগে অনেকে সতর্ক হবেন।'
Share To:

kakdwip.com

Post A Comment:

0 comments so far,add yours