ছেলের বিয়ে ডিসেম্বরে। আর ২৪ ক্যারেটের সোনার প্রতি ১০ গ্রামের দাম, ১০ অগস্ট ছিল ৫৬ হাজার ৮৫০ টাকা! বউয়ের মুখ দেখতে গেলেও আশীর্বাদের ওইটুকু গয়না তো করাতেই হবে! একটাই বাঁচোয়া, আপ্যায়নের খরচটা কোভিডের গুঁতোয় প্রায় শূন্য।  অনেকেই আগে থেকে করিয়ে রাখেন। একটু একটু করে। কিন্তু আবার অনেকেই, সে ছেলেই হোক বা মেয়েই হোক, মানুষ করার দায় মিটিয়ে আর সোনায় হাত দিতে পারেন না। কিন্তু বিয়ের সময় আমাদের দেশে শিক্ষাই ভূষণ ক’জন মানেন? সালঙ্কারা না হলে সমাজে ব্রাত্য। তাই ঘটি বাটি বিক্রি করে বিয়ের আয়োজন। আর ওই সোনাই খায় সিংহভাগ। বিশ্বে তাই সোনার চাহিদায় ভারত দ্বিতীয়।

কিন্তু শুধু কি গয়নার দাবিতেই সোনা? তাই যদি হত, তা হলে হঠাৎ সোনার দাম কেন কোভিড আক্রান্তের সংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আকাশকেই সীমা মানত? আসলে সোনার দামের সঙ্গে বাজারের অনিশ্চয়তার বিয়ে অনেক দিনের। অনিশ্চয়তা যত বাড়ে, সোনার দামও তত বাড়ে। তাই বাজারে সোনার দামের গতিবিধিকে বহু দিন ধরেই অনিশ্চয়তার একটা আপাত সূচক হিসাবে দেখা হয়। কেন? আসুন দেখে নেওয়া যাক সোনার দামের বাজারনীতি।
খুব কম কিছু ক্ষেত্র ছাড়া সোনার কিন্তু কোনও ব্যবহার মূল্য নেই। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সোনার কোনও প্রয়োজনই নেই। একই সঙ্গে সোনার নতুন কোনও খনিও মেলেনি বহু দিন। তাই চাহিদা বাড়লেও, সোনার জোগান তাল মিলিয়ে বাড়ার সম্ভাবনা কম বলেই, চাহিদার অল্প হেরফেরেই দামের হেরফের তুলনামূলক ভাবে অনেক বেশি। আর অবাক হবেন না, বিশ্বের সোনা উৎপাদকদের তালিকায় সেই চিনই শীর্ষে! এই হিসাব ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের। আর আমাদের দেশ চাহিদায় বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে থাকলেও উৎপাদনের ক্ষেত্রে পাত পায় না। কর্নাটকে দু’টি আর ঝাড়খন্ডের একটি খনিতে যা পাওয়া যায়, তা আমাদের চাহিদার ০.৫ শতাংশও নয়।

অনিশ্চয়তার বিমা:

সোনার গয়নার চাহিদায় বিশ্বে চিনের পরেই ভারত। তৃতীয় স্থানে সৌদি আরব আর তার পরেই সংযুক্ত আরব আমিরশাহি। কিন্তু শুধু গয়নার চাহিদাতেই সোনার দামের এত হেরফের হয় না। বাজারনীতি কিন্তু আরও একটা চাহিদার কথা বলে। আর তা হল সোনার দামের সঙ্গে বাজারের অনিশ্চয়তার ঘনিষ্ঠ যোগসূত্রের কথা। বাজারে যখন অনিশ্চয়তা বাড়ে, যেমন এখন, সোনার দাম তখন চড়তে থাকে। কারণ সোনা যে কোনও বাজারেই বিক্রি করা যায়। দেশের সীমায় তা আটকান যায় না। আর আজ কিনে রাখলে ১০০ বছর পরেও তা বিক্রি করা যাবে। 

টাকার বিনিময় মূল্য ও সোনার দাম:

দেশের আর্থিক হাল নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয় বাজারের হাল খারাপ হলে। আমরা যেহেতু সোনার চাহিদা মেটাতে আমদানির উপর নির্ভর করে থাকি, তাই টাকার দাম কমলে সোনা আমদানির খরচ বাড়ে। এই অঙ্কে বিশ্ববাজারে সোনার দাম এক থাকলেও, টাকার দাম পড়লে আমাদের বাজারে সোনার দাম বাড়ে। ২০২০ সালে এখনও পর্যন্ত ডলার পিছু টাকার দাম পড়েছে ৭ শতাংশের উপর। এটা বুঝতে একটা উদাহরণ নেওয়া যাক। ধরে নিই, এক ডলার দামের কিছু কিনতে আগে ৬৭ টাকা লাগত। কিন্তু এখন যদি তা কিনতে ৭২ টাকা লাগে তা হলে দেশের বাজারে তার দাম কিন্তু বাড়ল পাঁচ টাকা। ডলারে সেই জিনিসের দাম এক থাকলেও, টাকায় কিন্তু তার দাম বেড়ে গেল।

তাই সোনার দাম বাড়ার পিছনে একটা কারণ হল টাকার দাম পড়ে যাওয়া। কিন্তু অনিশ্চয়তার গুঁতো কোভিডের কারণে গোটা বিশ্ববাজারকেই টলিয়ে দিয়েছে। তাই মার্কিন বাজারেও সোনার দাম চড়েছে। ওদের হিসাব হয় আউন্সে, যা আমাদের ৩০ গ্রামের মতো। আজ তার দাম ২০০০ ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছে। ডলারের দাম ৭২ টাকা ধরলে তা দাঁড়ায় ১ লক্ষ ৪৪ হাজার টাকায়। আর ১০ গ্রামের দাম দাঁড়ায় ৪৮ হাজার টাকার মতো! সোনার দাম আমাদের বাজারে তাই আরও বাড়বে।


২০০৮ সালেও ঠিক একই ঘটনা ঘটেছিল। মার্কিন সাবপ্রাইম সঙ্কটে গোটা বিশ্বে মন্দা ছেয়ে যায়। বাজারের উপর ভরসা হারিয়ে মানুষ বিনিয়োগ সরায় সোনায়। ওই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে মার্কিন বাজারে সোনার দাম দাঁড়ায় আউন্স পিছু ১৯০০ ডলারে। সেই দাম বাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে থিতু হতে গড়িয়ে যায় ২০১৫। আর ২০১৫ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত কিন্তু সোনার দাম ১০০০ থেকে ১৩০০ ডলারের মধ্যেই ঘুরে বেরিয়েছে। তাল মিলিয়ে আমাদের দেশে সোনার দাম অনেকটাই থিতু হয়েছিল ওই সময়ে। ঘুরে বেরিয়েছে ২৬ থেকে ৩০ হাজারের মধ্যেই।

সুদ ও সোনা:

সুদের হার কমলেও কিন্তু সোনার চাহিদা বাড়ে। মানুষ সোনাকে দেখে সময় নিরপেক্ষ সঞ্চয়ের গন্তব্য হিসাবে। আজ যদি বাজার ধসে যায়, ব্যাঙ্ক ঢুবে যায়, আমানত যাবে। কিন্তু সোনা থাকবে। তাই সুদ কমলে সোনার চাহিদা তাল মিলিয়ে বাড়ে। ভারতে প্রকৃত সুদের হার শূন্যের তলায়। গত চার মাস ধরে কল কারখানা বন্ধ। শেয়ার বাজার থেকে মানুষ টাকা সরাচ্ছে। কিন্তু কোথায় সরিয়ে রেখে নিশ্চিন্ত থাকবে? তাই সবাই সোনাকেই আঁকড়ে ধরছে, যত দিন না পর্যন্ত বাজারের এই অনিশ্চয়তার মেঘ কাটে।

মূল্যবৃদ্ধি আর সোনা:

আর অবশ্যই সোনার দাম বাড়ে জিনিসপত্রের দাম যদি লাগামছাড়া হয়। বাজারে উৎপাদন নেই, সুদ কমেছে কিন্তু বিনিয়োগ হচ্ছে না। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সুদের হার কমিয়ে আমানতে সঞ্চয় থেকে উৎপাদনে বিনিয়োগে ঘোরাতে চাইছে মানুষের সঞ্চয়কে। একই সঙ্গে বাজারে ৩ লক্ষ ৭৪ হাজার কোটি টাকার উপর নগদের জোগান বাড়িয়েছে, যাতে বাজারে চাহিদা বাড়ে। কিন্তু বাজারের উপর আস্থা খুব না থাকায় বিনিয়োগ বাড়ছে না, উৎপাদনের ঘাটতি রয়েছে। আর তাই সব মিলিয়ে বেড়ে চলেছে জিনিসপত্রের দাম। মানুষের অতিরিক্ত টাকা তাই নিশ্চিত আশ্রয় খুঁজছে সোনায়।

এই মুহূর্তে তাই সোনার দামে কোনও লাগামের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। যত দিন মানুষ মনে করবে বাজারে সোনার যা দাম আর অনিশ্চয়তার গভীরতা যা, তাতে ওই দামে সোনা কেনাটাই লাভের, ঠিক তত দিনই চড়তে থাকবে দাম।

তা হলে?

সাধারণত রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এ অবস্থায় বাজার সামলাতে ঘরের সোনা বাজারে ছাড়ে। শীর্ষ ব্যাঙ্কটির ‘রিপোর্ট অন ম্যানেজমেন্ট অব ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভস’ অনুযায়ী ৬১২ টনের উপর সোনা রাখা আছে। আট বছর বাদে, গত অর্থ বছরে ৪০.৪৫ টনের মতো সোনা কেনে ব্যাঙ্কটি। এর মধ্যে ৩৬১ টনের একটু কম রাখা আছে ব্যাঙ্ক অব ইংল্যান্ড ও ইন্টারন্যাশন্যাল ব্যাঙ্ক ফর সেটেলমেন্টের ভল্টে আর বাকিটা আছে ব্যাঙ্কটির নাগপুর ভল্টে।

২০১৮ সালে দেশের বাজারে ৭৬০ টনের সোনা বিক্রি হয়েছিল। গত বছর তা কমে দাঁড়ায় ৬৯০ টনে। তা হলে কোভিডের বাজারে যখন বাজার বন্ধ তখনও সোনার দাম এত বাড়ে কী করে? এর উত্তর একটাই— আমাদের দেশে সোনার দাম বাড়ছে যতটা না গয়নার চাহিদায়, তার থেকেও বোধহয় বেশি বাড়ছে বাজার নিয়ে মানুষের আতঙ্কের জায়গা থেকে সঞ্চয়ের নিশ্চিত গন্তব্য হিসাবে।

মার্কিন বাজারে ৪৮ হাজার টাকায় দশ গ্রাম সোনার দামের সঙ্গে ১২ শতাংশ আমদানি কর যোগ করলে কিন্তু আমাদের বাজার দরের সঙ্গে বিদেশের বাজার দরের খুব ফারাক নেই। তাই বিরাট কিছু ফাটকা যে চলছে সোনা নিয়ে, তা কিন্তু এখনও বলা যাচ্ছে না। এই অবস্থায় তাই রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বাজারে সোনা ছাড়ার সম্ভাবনাও কম। 

সব মিলিয়ে ২০২১ সালের মধ্যে সোনার দাম কমার যে খুব একটা সম্ভাবনা আছে তা অন্তত গোটা বাজারের অনিশ্চয়তার হাল দেখে মনে হচ্ছে না। তাই ভাবুন সালঙ্কারা না শিক্ষা, সন্তানের বিয়েতে ভূষণ হিসাবে কোনটা বাছবেন? সোনার দাম কিন্তু এখন বাড়তেই থাকবে।

Share To:

kakdwip.com

Post A Comment:

0 comments so far,add yours