পাকিস্তানকে কেন টাকা দিল IMF?
আইএমএফ-এর নিয়ম অনুসারে, ভোটাভুটির মাধ্যমে ঠিক করা হয় কেউ ফান্ড পাবে কিনা। তবে এখানে বিপক্ষে ভোটদান করা যায় না। হয় পক্ষে ভোট দিতে হয় না হলে ভোটদানে বিরত থাকতে হয়। তাই বিরোধীরতা করে ভোট দান থেকে বিরত থাকে ভারত। এর পরেই অনুমোদন দেওয়া হয়।



ভারত-পাক যুদ্ধ আবহে খানিকটা হলেও অর্থকষ্ট কমেছে পাকিস্তানের। আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডার বা ইন্টারন্যাশানাল মানিটরি ফান্ড ওরফে আইএমএফ পাকিস্তানকে প্রায় ১০০ কোটি মার্কিন ডলার অতিরিক্ত ঋণ মঞ্জুর করেছে। ভারতীয় মুদ্রায় যার অঙ্কটা হয় প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা।

শুক্রবার, আইএমএফ বোর্ডের এই বৈঠকে বারবার পাকিস্তানকে অর্থ সাহায্য করার বিরোধিতা করে ভারত। বিরোধিতায় ভারত এও জানায় যে এর আগে ঋণের টাকা ব্যবহারের ক্ষেত্র পাকিস্তানের ‘খারাপ ট্র্যাক রেকর্ড’ রয়েছে। ওয়াশিংটনের ওই বৈঠকে ভারত জানিয়েছিল যে ঋণের শর্ত মানতে ব্যর্থ হয়েছে পাকিস্তান। আইএমএফ-এর কাছে এর আগেও দীর্ঘ দিন ঋণ নিয়েছে পাকিস্তান। কিন্তু তা ব্যবহারের শর্ত মানেনি। ওই টাকা সীমান্তে সন্ত্রাস ছড়াতে ব্যবহার করেছে পাকিস্তান। ২৮ বছর ধরে পাকিস্তান ঋণ নিলেও কোনও উন্নতি হয়নি। ২০১৯ থেকে চারটি আইএমএফ প্রকল্পের অধীনে ঋণ নিয়েছে তাঁরা। সেই টাকা ঠিক করে ব্যবহার করলে আর ঋণ নিতে হত না। কিন্তু ভারতের কথায় কাজ হয়নি।

আইএমএফ-এর নিয়ম অনুসারে, ভোটাভুটির মাধ্যমে ঠিক করা হয় কেউ ফান্ড পাবে কিনা। তবে এখানে বিপক্ষে ভোটদান করা যায় না। হয় পক্ষে ভোট দিতে হয় না হলে ভোটদানে বিরত থাকতে হয়। তাই বিরোধীতা করে ভোট দান থেকে বিরত থাকে ভারত। এর পরেই অনুমোদন দেওয়া হয়।

এর আগে কতবার টাকা নিয়েছে পাকিস্তান?

আইএমএফ-এর বোর্ড মিটিংয়ে ভারতের সওয়াল অনুসারে ২৮ বছর ধরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বারবার আইএমএফের থেকে ঋণ নিয়েছে পাকিস্তান। বছর দুয়েক আগে আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডারের কাছ থেকে সাতশো কোটি ডলারের ঋণের প্যাকেজ পেয়েছিল পাকিস্তান। ২০১৯ সাল থেকে ৪ বার অর্থ ধার করেছে পাকিস্তান। ২০২৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ৩৭ মাসের EFF-এর অধীনে মোটা টাকার অর্থ ঋণ পেয়েছিল পাকিস্তান। শুক্রবার EFF (Extended Fund Facility) এবং RSF (Resilience and Sustainability) অধীনে যথাক্রমে ১ বিলিয়ন এবং ১.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ পেল পেয়েছে পাকিস্তান। অর্থাৎ মোট ২.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার টাকা পেল।

পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কী কী অভিযোগ?

গত ৫ বছর ধরে চারবার টাকা পেয়েছে পাকিস্তান। EFF-এর অধীনে মোট ৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের মধ্যে থেকেই এই টাকা পেয়েছে পাকিস্তান। টাকা দেওয়ার ক্ষেত্রে আইএমএফ শর্ত দিয়েছিল কিছু।

তার মধ্যে ছিল অর্থনৈতিক স্থায়িত্ব প্রতিষ্ঠা করা, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কার করা। জনসেবা সরবরাহ এবং জ্বালানি খাতের কার্যকারিতা উন্নত করা, জলবায়ুর ক্ষেত্রে স্থিতিস্থাপকতা তৈরি করার মতো একাধিক মানবকল্যাণে হিতকর কাজ করা।

সমস্যা হল দিনের পর দিন টাকা পেলেও সেই টাকা সন্ত্রাসবাদকে ছড়িয়ে দিতে এবং সীমান্তবর্তী এলাকায় পরিবেশ অশান্ত করতে ব্যবহার করেছে পাকিস্তান। দিনের পর দিন উশকানি দিয়েছে ক্রস বর্ডার সন্ত্রাসবাদকে। যে টাকায় দেশের উন্নতি করার কথা, তা দিয়ে লালন পালন করেছে মাসুদ আজহারের মতো জঙ্গিদের।

এখানেই শেষ নয়। পাকিস্তানের সব ক্ষেত্রেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে একটা বড় ভূমিকা পালন করে পাক সেনা। অর্থনৈতিক বরাদ্দেও তার বিকল্প নেই। তাই অর্থ দফতর চাইলেও শেষ পর্যন্ত বরাদ্দ টাকা পাক সেনার প্ররোচনাতেই খরচ হয় সন্ত্রাস, হিংসা এবং ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানোর কাজে।

কী কী ক্ষেত্রে টাকা বরাদ্দ করে আইএমএফ?

আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডার তখনই কোনও দেশকে অর্থ সাহায্য করে, যখন সেই দেশ গুরুতর অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে। বৈদেশিক মুদ্রার অভাবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়।

IMF কখন কোনও দেশকে সাহায্য করবে তার নির্দিষ্ট কিছু ভাগ রয়েছে। যেমন –

১। যদি কোনও দেশের বৈদেশিক রিজার্ভ কমে যায় এবং আমদানি বা ঋণ পরিশোধে সমস্যা হয়।

২। যদি দেশের আমদানি অনেক বেড়ে যায় এবং রপ্তানি কমে যায়, তখন ভারসাম্য রক্ষা করতে সাহায্য দরকার হয়।

৩। উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, বিনিয়োগের ঘাটতি বা ব্যাঙ্কিং সেক্টরের দুর্বলতার কারণে যখন দেশের অর্থনীতি হুমকির মুখে পড়ে।

৪। কোনও দেশ যদি আন্তর্জাতিক ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ার ঝুঁকির মুখে থাকে (debt default), তখন IMF হস্তক্ষেপ করে ঋণ দিয়ে সাহায্য করতে পারে।

৫। দেশের দীর্ঘমেয়াদী কাঠামোগত দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে কখনও কখনও IMF সাহায্যের পাশাপাশি অর্থনৈতিক সংস্কার (structural reforms) বাস্তবায়নের শর্ত দেয়।

কী কী ভাবে টাকা ধার দেয়?

১। Stand-By Arrangement (SBA): স্বল্পমেয়াদি সমস্যা মোকাবিলায় সাহায্য।

২। Extended Fund Facility (EFF): দীর্ঘমেয়াদি কাঠামোগত দুর্বলতা মোকাবিলায়। পাকিস্তান এই খাতে টাকা পেয়েছে।

৩। Rapid Financing Instrument (RFI): জরুরি অবস্থায় দ্রুত অর্থ সহায়তা (যেমন প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা মহামারির সময়)।

৪। Poverty Reduction and Growth Trust (PRGT): দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের দেশগুলোর জন্য বিশেষ সহায়তা কর্মসূচি।

৫। Resilience and Sustainability Facility (RSF): দেশে স্থিতিস্থাপকতা এবং স্থায়িত্ব সুবিধা গড়ে তোলা।

IMF অর্থ সহায়তা দেয়ার সময় সাধারণত বিভিন্ন আর্থিক ও কাঠামোগত সংস্কার বাস্তবায়নের শর্ত দেয়, যেন দেশটি ভবিষ্যতে আবার একই সংকটে না পড়ে এই উদ্দেশ্যেই সাহায্য করা হয়।

এখানে একটা কথা বলে রাখা ভাল ১৯৯৩ সালের পর থেকে ভারত আজ অবধি আইএমএফ-এর কাছ থেকে কোনও রকম অর্থ সাহায্য নেয়নি। আগের যা ঋণ ছিল তাও ৩১ মে ২০০০ সালের মধ্যেই শোধ করে দেয়।

কী ভাবে ভোট হয় আইএমএফ বোর্ডের?

আইএমএফের সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী সংস্থা বোর্ড অফ গভর্নরস। এই বোর্ড প্রতিটি সদস্য দেশের জন্য একজন গভর্নর এবং একজন বিকল্প গভর্নর নিয়ে গঠিত। গভর্নর সদস্য দেশ কর্তৃক নিযুক্ত হন। সাধারণত অর্থমন্ত্রী বা কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক গভর্নর হন। আইএমএফের সমস্ত ক্ষমতা গভর্নর বোর্ডের উপর ন্যস্ত। গভর্নর বোর্ড কিছু সংরক্ষিত ক্ষমতা ব্যতীত সমস্ত ক্ষমতা নির্বাহী বোর্ডকে অর্পণ করতে পারে। গভর্নর বোর্ড সাধারণত বছরে একবার বৈঠক করে।

মনে রাখবেন, আইএমএফ-এর অধীনে সকলে ভোট দিলেও সব দেশের ভোটদানের পাল্লা সমান নয়। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উপর নির্ভর করে ঠিক হয় ওই দেশের ভোটের ভার কতটা। এ ক্ষেত্রে যেমন সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ আমেরিকা।

কার ভোটের ভার কত?

আমেরিকা – ১৬.৪৯% জাপান – ৬.১৪% চিন – ৬.০৮% জার্মানি – ৫.১% ফ্রান্স – ৪.০৩% ব্রিটেন – ৪.০৩% ইতালি – ৩.০২% রাশিয়া – ২.৫৯% ব্রাজিল – ২.২২% সৌদি আরব – ২.০১% দক্ষিণ আফ্রিকা – ০.৬৩% পাকিস্তান – ০.৪৩% বাংলাদেশ – ০.২৪% ভারত – ২.৬৩%

এখানে একটা কথা বলে রাখা ভাল। উপরিক্ত তালিকা থেকেই স্পষ্ট কোনও দেশ অনুদান পাবে কিনা তা নির্ধারণের ক্ষেত্রে আমেরিকা, জাপান, জার্মানি, চিন, ব্রিটেন বা রাশিয়ার মতো দেশের মতামত কতটা গুরুত্বপূর্ণ। সেক্ষেত্রে সর্বাধিক ক্ষমতার অধিকারী আমেরিকা। অথচ সন্ত্রাসবাদের বিপক্ষেই বরাবর কথা বলেছে ট্রাম্পের দেশ। পহেলগাঁও হামলার পরে ভারতের পাশেও দাঁড়িয়েছে। কিন্তু মুখে এক কথা বললেও কাজের ক্ষেত্রে তার প্রতিফলন দেখা গেল না। আইএমএফ-এর টাকা দেশের উন্নয়নের নাম করে নিয়েও পাকিস্তান বারবার তা ব্যবহার করেছে সন্ত্রাসবাদকে ইন্ধন জোগাতে। ভারত যখন পাকিস্তানের ঘরে ঢুকে জঙ্গি দমন করছে তখন ফের পাকিস্তানের হাতে এত এত টাকা তুলে দিয়ে সন্ত্রাসবাদের হাতকেই শক্ত করছে না তো আমেরিকা? ভারত-পাক যুদ্ধের আবহেই বা এর প্রভাব কতটা ভয়ানক হতে পারে তাও বড় প্রশ্ন!
Share To:

kakdwip.com

Post A Comment:

0 comments so far,add yours