বাড়িতে থাকা মানেই আলাদা ঘরে নিজের খুশি মতো থাকা।— কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে এই মানসিকতা থেকে দ্রুত সবাইকে বেরিয়ে আসতে হবে। মাথায় রাখতে হবে, বাড়িতে থাকা মানে ‘হাসপাতালেরই একটি অংশে রয়েছি’। মৃদু উপসর্গ নিয়ে যাঁরা বাড়িতে রয়েছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে এই ভাবনাই রক্ষাকবচ, জানাচ্ছেন চিকিৎসকেরা। মৃদু উপসর্গ নিয়ে এই মুহূর্তে কলকাতা-সহ রাজ্যের অসংখ্য মানুষ বাড়িতেই রয়েছেন। হুগলির চন্দননগরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট দেবদত্তা রায়ও মৃদু উপসর্গ নিয়ে প্রথমে বাড়িতেই ছিলেন। দেবদত্তার মৃত্যুর পরে তাই এই পরিস্থিতির তাৎপর্য আলাদা হয়ে গিয়েছে। 
এখন যে প্রশ্নটি জনসাধারণের বড় অংশের মধ্যে উঠছে তা হল, বাড়িতে থাকাকালীন যদি হঠাৎ শরীরের অবনতি হয়, তা হলে কী হবে? যদিও এ বিষয়ে স্পষ্ট সরকারি বিধি রয়েছে, কিন্তু তার পরেও কোথাও ‘যোগাযোগ’-এর অভাব তৈরি হচ্ছে বলে মনে করছেন অনেক চিকিৎসকই। তাঁদের বক্তব্য, হাসপাতালে থাকাকালীন যে যে নিয়মগুলি পালন করা দরকার, বাড়িতে থাকাকালীনও সেই সমস্ত নিয়ম অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হবে। সব থেকে আগে দেখতে হবে যে, শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা ঠিক রয়েছে কি না। এ ক্ষেত্রে বাড়িতে একটি অক্সিজেন মাপার যন্ত্র কিনে নেওয়াই ভাল, জানাচ্ছেন চিকিৎসকেরা।
তাঁরা জানাচ্ছেন, সুস্থ মানুষের শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা ৯৫-৯৬ থাকে। সেটি ৯৪-এর নীচে নামলেই সতর্ক হতে হবে। কার্ডিয়োথোরাসিক চিকিৎসক কুণাল সরকার জানাচ্ছেন, শ্বাসকষ্ট হচ্ছে না বলে অগ্রাহ্য করা যাবে না মোটেই। অক্সিজেনের মাত্রা ৯৪ বা তার কম হলে সেটি ‘সিগন্যাল’ বলে ধরতে হবে। কারণ, সার্স-কোভ-২ সবার আগে শ্বাসযন্ত্রকে আক্রমণ করে। ফলে পরিস্থিতির অবনতি হওয়া মানেই শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা দ্রুত কমতে থাকে। কুণালবাবুর কথায়, ‘‘মৃদু উপসর্গ নিয়ে যাঁরা বাড়িতে রয়েছেন, তাঁরা যদি মনে করেন ভাল আছেন, সেটি বিপজ্জনক। ঘরবন্দি মানেই কোভিড রোগী সুরক্ষিত, এমন ভাববেন না। তা ছাড়া কোভিড পজ়িটিভ রোগীর ক্ষেত্রে অক্সিজেন মাপার যন্ত্র না থাকলে বাড়িতে থাকা কিছুটা ঝুঁকির হবে।’’
ঝুঁকির কারণ ব্যাখ্যা করে চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, কোভিড-১৯-এ ‘হ্যাপি হাইপক্সিয়া’ হয়। এই মুহূর্তে সারা বিশ্বে এই নিয়েই চর্চা চলছে। কেউ হয়তো বাড়িতে আনন্দে (হ্যাপি) রয়েছেন, কিন্তু ভিতরে ভিতরে তাঁর ‘হাইপক্সিয়া’ হচ্ছে, অর্থাৎ শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাচ্ছে। অথচ তিনি তা খেয়ালই করছেন না। মেডিসিনের চিকিৎসক অরুণাংশু তালুকদারের কথায়, ‘‘বাড়িতে থাকাকালীন শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা ঠিক রয়েছে কি না, সেটা দেখাই সব থেকে বড় কাজ। অক্সিজেনের মাত্রা যদি ধারাবাহিক ভাবে ৯৪-এর কম থাকে, তা হলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের সঙ্গে বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যোগাযোগ করতে হবে। শ্বাসকষ্টের জন্য অপেক্ষা করলে হবে না। কারণ, শ্বাসকষ্ট হচ্ছে না অথচ শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাচ্ছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এমনটাই হচ্ছে।’’ এক সরকারি চিকিৎসকের কথায়, ‘‘এক দিনে কিন্তু মৃদু উপসর্গ থেকে কেউ মডারেট বা ক্রিটিক্যাল পর্যায়ে পৌঁছন না। সে জন্য দু’-এক দিন সময় লাগে। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে না অতএব ভাল আছি, এমন নয়। দেখা যাচ্ছে, শ্বাসকষ্ট শুরু হলে অক্সিজেন এক ধাক্কায় ৭০-এ নেমে গিয়েছে। তখন পরিস্থিতি জটিল হয়ে যায়।’’
চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, অন্য সংক্রমণের ভয়েই মৃদু উপসর্গযুক্ত রোগীদের সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা হাসপাতাল থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয় বাড়িতে থাকার। কারণ, বাড়িতে থাকা মানে ‘স্বচ্ছন্দ’ ভাবে থাকা যায়। সে ক্ষেত্রে কোন পরিস্থিতিতে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে, তার উল্লেখ রয়েছে। সেই তালিকায় শ্বাসকষ্ট, ধারাবাহিক ভাবে বুকে চাপ অনুভব, মানসিক বিভ্রান্তি-সহ একাধিক বিষয় রয়েছে। সেখানে গা-ঢিলেমি দিলেই মুশকিল। মেডিসিনের চিকিৎসক সৌমিত্র ঘোষ বলছেন, ‘‘বাড়িতে থাকার বিষয়টি ঐচ্ছিক। ওই সময়ে পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে। বাড়িতে থাকাকালীন কেউ যদি ইচ্ছে মতো ঘোরাফেরা বা অন্য কাজকর্ম করেন, স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর শরীরে অক্সিজেনের চাহিদা বাড়বে। কিন্তু শরীরে অক্সিজেনের চাহিদা যাতে না বাড়ে, সেটাই বার বার বলা হচ্ছে। অসুস্থতা বোধ করলেই দ্রুত চিকিৎসক বা কাছের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যোগাযোগ করতে হবে।’’
Share To:

kakdwip.com

Post A Comment:

0 comments so far,add yours