দুই জেলাকে সামনে রেখে মিম ঘুঁটি সাজালেও নেতাদের কথা শুনে মনে হচ্ছে, বাংলা নিয়ে সব হোমওয়ার্ক সেরে ফেলেছেন তাঁরা। মিমের রাজ্য কমিটির সদস্য টনিক খান বলেন, "সব আসনে প্রার্থী দেব। বাঘের বিরুদ্ধে বাঘ হয়ে লড়াই করব।" এই আবহে তৃণমূলের স্থানীয় নেতাদের কথা স্পষ্ট যে মাথাব্যাথা অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছেন ওয়েইসি।
রাতের অন্ধকারে তৃণমূলের 'সর্বনাশ' করছে মিম!
অল ইন্ডিয়া মজলিস-এ ইত্তেহাদুল মুসলিমিন। যাঁরা রাজনৈতিক চর্চা করেন, তাঁরা বাদ দিলে অনেক বাঙালি হয়ত এই রাজনৈতিক দলটার নামই জানেন না। অথচ সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, সন্ধ্যে নামলেই বাংলার গ্রামে গ্রামে পৌঁছে যাচ্ছে ওরা। বাংলার ঘরে ঘরে ঢুকে সুখ-দুঃখের খবর নিচ্ছে নিজামের শহরের রাজনৈতিক দল। বাংলার ভোটের আগে কোন খেলা ঘোরাতে আসরে নামল মিম? প্রশ্ন উঠছে রাজনৈতিক মহলে।
ডালপালা ছড়াচ্ছে মিম
ই-সিগারেটে তৃণমূল সাংসদের সুখটান নিয়ে অভিযোগ দায়ের অনুরাগের, কীর্তি বললেন, 'অনেকে করেন..'
স্বাধীনতার আগে তৈরি হওয়া মজলিস-এ ইত্তেহাদুল মুসলিমিনের নামের সঙ্গে পরবর্তীতে জুড়ে যায় ‘অল ইন্ডিয়া’। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক উপস্থিতি থাকলেও সাংসদের সংখ্যা এক। তবে সেই ২০০৪ থেকে পরপর পাঁচবারের লোকসভা ভোটে আসাদউদ্দিন ওয়েইসিকে হারাতে পারেনি কোনও দল। হায়দরাবাদের বাইরে দলের বিশেষ প্রাসঙ্গিকতা ছিল না দীর্ঘদিন। তবে সময় বদলাচ্ছে। ক্রমশ ডালপালা ছড়াচ্ছে মিম। তেলঙ্গানা, কর্নাটক, মহারাষ্ট্র পেরিয়ে পৌঁছে গিয়েছে একেবারে বাংলার সীমান্তে।
সদ্য শেষ হওয়া বিহার বিধানসভা নির্বাচনে পাঁচটি আসন জিতেছে ওয়েইসির দল। আমৌর, কোচাধামন, বাহাদুরগঞ্জ, জোকিহাট ও বাইসি। পূর্ণিয়া ও কিষাণগঞ্জের এই পাঁচ আসনে জয়ী হয়েছে মিম। ম্যাপটা ভাল করে দেখলেই বোঝা যাবে এই পূর্ণিয়া বা কিষাণগঞ্জের দূরত্ব বাংলার ইসলামপুর, রায়গঞ্জ বা কালিয়াগঞ্জের থেকে খুব একটা বেশি নয়। ২০১৫ য় একটা আসন দিয়ে যাত্রা শুরু করে মিমের পরপর দুবার পাঁচটি করে আসন পাওয়া চমকে দিয়েছে অনেককেই। পিছনে ফেলে দিয়েছে কংগ্রেস কিংবা প্রশান্ত কিশোরের দলকেও।
প্রশ্ন উঠেছে বিহারের সাফল্যের পরই কি ওয়েইসির লক্ষ্য বাংলা? না, চিত্রটা বলে দিচ্ছে, অনেক আগে থেকেই বাংলায় সংগঠন তৈরির চেষ্টা করছে মিম। একেবারে নীচুস্তর থেকে সংগঠন তৈরিতে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে তারা। তৈরি হচ্ছে বুথভিত্তিক সংগঠন।
কথা হয়েছিল একুশেও
একটু পিছনে ফিরে যাই। ২০২১। ভোটের মাস কয়েক আগে ফুরফুরা শরিফে এসে হাজির হয়েছিলেন আসাদউদ্দিন ওয়েইসি। কথা হয়েছিল আব্বাস সিদ্দিকীর সঙ্গে। সেই সময় ‘হায়দরাবাদের দলটা মুসলিম ভোট কাটবে’ বলে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন খোদ তৃণমূল সুপ্রিমো। কিন্তু সেবার বঙ্গের ভোটে বিশেষ দাঁত ফোটাতে পারেনি মিম। তলে তলে সংগঠন তৈরির কথা অবশ্য কান পাতলে শোনা যায়।
রাতের অন্ধকারে ঢুকছে মিম
২১-এ তেমন কোনও ভূমিকা ছিল না মিমের। কোনও প্রভাবও পড়েনি। আর এবার? একেবারে নতুন রণকৌশল। রাতের অন্ধকার নামলেই পাড়ায় পাড়ায় হাজির হচ্ছে মিম। চায়ের দোকানে বেঞ্চ পেতে বসে যাচ্ছে, সংখ্যালঘু পরিবারগুলিকে বোঝানো হচ্ছে, কীভাবে তেজপাতার মতো তাদের ব্যবহার করছে তৃণমূল। মিমের সদস্যরা তৃণমূলের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিচ্ছে। বিশেষত ওয়াকফ আইন কার্যকর নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে তাদের। প্রথমে প্রতিবাদ করলেও কেন শেষ পর্যন্ত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ওয়াকফ আইন কার্যকর করে নোটিস দিলেন, সেই প্রশ্ন তুলছে মিম।
বাড়ছে যোগদানের বহর
মিম নেতৃত্বের কথায় কি কোনও কাজ হচ্ছে? সেটা সময় বলবে। তবে যোগদানের বহর যে বেড়েছে, সেটা বোঝাই যাচ্ছে। সম্প্রতি মুর্শিদাবাদের রঘুনাথগঞ্জের সেকেন্দ্রা এলাকা তৃণমূল ছেড়ে বহু কর্মীকে মিমে যোগদান করতে দেখা যায়। তাদের হাতে দলীয় পতাকা তুলে দেয় স্থানীয় নেতৃত্ব। দক্ষিণ দিনাজপুরের কুমারগঞ্জ বিধানসভা এলাকাতেও দেখা যায় একই ছবি। সিপিএম ও তৃণমূল ছেড়ে বেশ কয়েকজন মিমে যোগদান করেন। মিমের জেলা সহ সভাপতি মহাম্মদ জালাল সরকার, ব্লক সভাপতি মাহাবুর মিয়া সহ একাধিক নেতা উপস্থিত ছিলেন সেখানে। মালদহেও দেখা যাচ্ছে যোগদানের ছবি। শুধুমাত্র চাঁচলে ৩০০-র বেশি তৃণমূলকর্মী মিমে যোগ দান করেছেন। রতুয়া, হরিশ্চন্দ্রপুর, মালতিপুর মিলিয়ে হাজারের বেশি।
চিন্তা বাড়ছে তৃণমূলের?
কর্মী সংখ্যা বেশি না হলেও মিমের উপস্থিতি যে বেশ প্রকট, তা তৃণমূল সুপ্রিমোর কথাতেই স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি এক জনসভায় দাঁড়িয়ে মমতা বলেছেন, “একটা নতুন মুসলিমদের দল এসেছে।” আর এই মুসলিম তথা সংখ্যালঘু ভোট নিয়েই আশঙ্কায় শাসক দল।
বিহারের সীমাঞ্চলে মূলত মুসলিম অধ্যুষিত আসনগুলিতেই সাফল্য পেয়েছে মিম। কারণ ওয়েইসির জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ হল, তিনি সংসদে সংখ্যালঘুদের কথা বলেন। ২০১১-র সেন্সাস অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম জনসংখ্যা ২৮ শতাংশ। বর্তমানে প্রায় ৩০ শতাংশের আশপাশে। রাজনৈতির বিশ্লেষকরা বলেন, এই সংখ্যালঘু ভোটারদের বেশিরভাগ ভোটই যায় তৃণমূলের ঝুলিতে। ২১-এর ভোটে আসরে আইএসএফ নামলেও নির্দিষ্ট একটি আসন বাদে বাকি রাজ্যে খুব বেশি প্রভাব ফেলতে পারেনি। ২৪-এর লোকসভা ভোটেও তাদের উপস্থিতি খুব উজ্জ্বল নয়। কিন্তু মিম যেভাবে জেলায় জেলায় সংগঠন বাড়াচ্ছে, তাতে ভোট-অঙ্কের হিসেব গুলিয়ে যেতে পারে বলে মনে করছেন অনেকেই।
মালদহ ও মুর্শিদাবাদে
উল্লেখ্য, গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে লালগোলার সীতেশনগরে মিমের এক প্রার্থী জয়ী হন। তিনি এখনও মিমেই রয়েছেন। মালদহ ও মুর্শিদাবাদের সবকটি বিধানসভায় আসনেই এবার তাঁরা প্রার্থী দেবেন বলে জানিয়ে দিয়েছেন। মালদহে ২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল পেয়েছিল ৮টি আসন, বিজেপি চারটি। কিন্তু ২০২৪-এর লোকসভা ভোটে হিসেব উল্টে যায়। সেই ভোটে ৬ আসনে লিড পায় বিজেপি, ৬ আসনে কংগ্রেস। তৃণমূলের জমি কি সরছে? আর সেই সেই ফাঁকেই ঢুকে পড়তে চাইছে মিম?
এদিকে, মুর্শিদাবাদে তো অন্য হিসেব-নিকেশ শুরু হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যেই। কারণ সব ঠিক থাকলে দিন ১০-১২র মধ্যেই নতুন দল ঘোষণা করবেন হুমায়ুন কবীর। রাজ্যের সংখ্যালঘু অধ্যুষিত সব আসনে প্রার্থী দেবেন বলে জানিয়ে দিয়েছেন তিনি। তাঁর মুখেও শোনা যাচ্ছে সেই হায়দরাবাদের সাংসদের নাম। হুমায়ুন স্পষ্ট বলেছেন, “নতুন দল ঘোষণা করব। ১৩৫টি আসনে প্রার্থী দেব। ওয়েইসির সঙ্গে জোট করব।”
দুই জেলাকে সামনে রেখে মিম ঘুঁটি সাজালেও নেতাদের কথা শুনে মনে হচ্ছে, বাংলা নিয়ে সব হোমওয়ার্ক সেরে ফেলেছেন তাঁরা। মিমের রাজ্য কমিটির সদস্য টনিক খান বলেন, “সব আসনে প্রার্থী দেব। বাঘের বিরুদ্ধে বাঘ হয়ে লড়াই করব।” এই আবহে তৃণমূলের স্থানীয় নেতাদের কথা স্পষ্ট যে মাথাব্যাথা অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছেন ওয়েইসি। মালদহে তৃণমূলের জেলা সভাপতি আব্দুল রহিম বক্সী কোনও দলের নাম না করে বলেন, “বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়ে রাতের অন্ধকারে গোপন আস্তানায় মিটিং করে যারা ঠিক করছ মালদহের বুক থেকে তৃণমূলকে মুছে দেবে, যে মাথার খুলির ভিতরে এই ধরনের চিন্তাভাবনা হয, সেই খুলিটাকে ভেঙে চুরমার করে দেব।” এদিকে বিজেপির রাজ্য সভাপতি শমীক ভট্টাচার্য বলছেন, বাংলায় কোনও বিভাজনের রাজনীতি চলবে না।
প্রশ্ন উঠছে বিভাজন, মেরুকরণ শব্দ গুলো কি বাংলার রাজনীতির সঙ্গে আরও বেশি করে জুড়ে যাচ্ছে? একুশের থেকে কি অনেকটাই আলাদা অঙ্ক কষতে হবে ছাব্বিশের ভোটে?


Post A Comment:
0 comments so far,add yours