বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সোনায় বাবল্ তৈরি হয়েছে। যে কোনও সময় ফাটতে পারে অর্থাৎ, সোনার দাম কমতে পারে। তবে এও ঠিক, সোনা এমন একটি বস্তু যা রাতারাতি অনেকটা পতন হয়ে যাবে, তেমন নয় কারণ, অর্থনীতিতে সোনা 'Safe Haven'...
৪ঠা অগ্রহায়ণ ১৩৬৬ সন। কলকাতার ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন। সোনার প্রতি মানুষের আস্থা অসীম, কারণ সোনা দুর্লভ। সোনা দুর্মূল্য। সোনা অক্ষয়। এই আস্থার মূলে প্রচণ্ড আঘাত পড়েছিল পরেশচন্দ্র দত্তের কীর্তিকলাপ। এই মহানগরীর ৩০ লক্ষ জনতার মধ্য সে দিন যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল তার তুলনা বিরল। সোনা অপরিযাপ্ত হবে অতএব সোনার মূল্য আর থাকবে না, এই বিভীষিকা জনসাধারণকে উদ্ভ্রান্ত করে তুলেছিল। সঞ্চিত সোনা বিক্রি করার মরসুম লেগে গিয়েছিল স্বর্ণকারের দোকানে দোকানে। যারা অপেক্ষাকৃত বিত্তশালী, তাদের উত্তেজনার কারণ ছিল শেয়ার বাজারের অবস্থা। সোনার মূলের সঙ্গে শেয়ার মূল্যের সম্বন্ধ অচ্যুত…
কী! মনে পড়ছে সেই দৃশ্য? ঠিক এভাবেই পরেশ পাথর সিনেমায় সোনার মূল্য বুঝিয়েছিলেন সত্যজিত রায়। তুলসী চক্রবর্তী ওরফে পরেশ চক্রবর্তীর হাত দিয়ে কারণ তাঁর হাতে ছিল সেই অমূল্য পাথর, যা ছোঁয়ালেই হয়ে যাচ্ছে সোনা। আর এই খবর যখন সবাই জানতে পারে, তখনই হু হু করে পড়তে থাকে সোনার দাম। শেয়ার মার্কেটে ধস। মা-দিদিমাদের গচ্ছিত সোনা বিক্রি করার হিড়িক পড়ে যায় সবার মধ্যে। সবার মনে হচ্ছে, রাস্তায় পড়ে থাকা পাথরের যা দাম, সোনার হয়তো তাই দাম হয়ে যাবে। আর এই ভয়ে সবাই বিক্রি করছে সোনা। মাত্র একটা খবরে আকাশ ছোঁয়া সোনা রাতারাতি পথের ভিখারি হয়ে যায়। এ তো গল্প, কিন্তু ‘গল্প’ আদৌ কি সত্যি হতে পারে? সোনার মূল্য সত্যিই কি এত ঠুনকো? এই মুহূর্তে সোনা, প্রতি দশ গ্রামের দাম ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা। এক বছর আগে যার দাম ছিল ৭২ হাজার টাকা, ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সোনায় বাবল্ তৈরি হয়েছে। যে কোনও সময় ফাটতে পারে অর্থাৎ, সোনার দাম কমতে পারে। তবে এও ঠিক, সোনা এমন একটি বস্তু যা রাতারাতি অনেকটা পতন হয়ে যাবে, তেমন নয় কারণ, অর্থনীতিতে সোনা ‘Safe Haven’। যেখানে রাষ্ট্র সোনায় বিনিয়োগ করে, তার স্থিতাবস্থা মজুবতই থাকে। তাহলে সোনা কি কোনও দিন মূল্যহীন হতে পারে? বিশেষজ্ঞরা এক কথায় বলছেন ‘না’। মূল্য কমতে পারে, শূন্য হতে পারে না। কতটা মূল্য কমতে পারে? কখন কমতে পারে?
প্রথম: বাজারের স্বাভাবিক নিয়ম। অর্থাৎ যখন সোনার চাহিদা বাড়ে, তখন সোনার দাম বাড়ে। সোনার ক্ষেত্রে এই চাহিদাটা ম্যানুয়ালি কমানো বাড়ানো যায়। যখনই মুদ্রাস্ফীতি বাড়তে থাকে, তখন সরকার সাধারণত সোনা বেচে। বাজারে লিক্যুডিটি তৈরি হয়। এরফলে সোনার দাম কমতে পারে। তবে, সোনার ইতিহাস দেখলে, কিছুটা কমলেও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে।
দ্বিতীয়: বিশ্বে যখন শান্তি থাকবে, তখন সোনার দাম কমবে। কোনও যুদ্ধ নেই, আর্থিক মন্দা নেই অর্থাৎ বিনিয়োগকারীরা নির্বিঘ্নে বিনিয়োগ করছেন, তখন সোনার দাম ধীরে ধীরে কমতে পারে। ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালে এই স্থিতাবস্থা লক্ষ্য করা গিয়েছিল। কিন্তু যে বিশ্বে কিম জং উন রয়েছেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প, ভ্লাদিমির পুতিন, শি জিনপিং বা নেতানিয়াহু রয়েছেন, সেখানে শুধু শান্তি! নৈব নৈব চ।
তৃতীয়: সুদের হার বাড়লে সোনার দাম কমে। ফিক্স ডিপোজিট, বন্ড থেকে স্থায়ী আমানতে যদি সুদের হার বাড়ে তখন সোনায় বিনিয়োগ কমিয়ে উৎসাহ বাড়ে এই সব ক্ষেত্রে বিনিয়োগে। পাশাপাশি, শেয়ার বাজার বা ক্রিপ্টো কারেন্সি বাজার বুম থাকলে, ঠিক একই নিয়মে বিনিয়োগকারীরা সোনায় ছেড়ে এই সব জায়গায় বিনিয়োগ করেন। তখন সোনার চাহিদা কমে এবং দামও কমে।
চতুর্থ: বিয়ে বা উৎসবের মরসুম না থাকলে। খুব সহজ কথা, বিয়ে বা উৎসবে সোনার কেনার হিড়িক পড়ে। তাতে সোনার চাহিদা তৈরি হয়। আর তার ফলেই হলুদ ধাতুর বড্ড ঘ্যাম দেখা যায়।
এ তো গেল অর্থনীতির নিয়ম মেনে চক্রাকারে সোনার ওঠা-নামা। কিন্তু যেহেতু নামটা যখন সোনা, তাকে নিয়ে মানুষের স্বপ্ন দেখার শেষ নেই। কে না চায় একটা সোনার ঘড়ি, সোনার হার বা কানের, সোনার পাথর বাটি…সরি। সোনা কেনাই তো এই মুহূর্তে মধ্যবিত্তের কাছে সোনার পাথরবাটি। তবুও চলুন কিছু হাইপোথিটিক্যাল থিওরির দিকে চোখ রাখা যাক, যা নিয়ে ইন্টারনেট দুনিয়ায় মাঝে মাঝে চর্চা হয়ে থাকে।
সোনায় বিনিয়োগে অনীহা: আজ আমরা AI যুগে প্রবেশ করে ফেলেছি। অলরেডি বিনিয়োগের ভাবধারা বদলে গিয়েছে। যেভাবে প্রতি মুহূর্তে সময় বদলে যাচ্ছে, মানুষের চিন্তাভাবনা বদলে যাচ্ছে, কে বলতে পারে ১০০ বছর পর সোনাকে বিনিয়োগের অপরিহার্য সম্পদ না-ই মনে করতে পারে মানুষ। সে সময় কাগজে টাকা বলে কোনও বস্তুই থাকল না, সবই ডিজিটাল। সোনার ক্ষেত্রেও শুধু মাত্র ডিজিটালে লেনদেন হবে। বাস্তবে হলুদ ধাতুর কোনও অস্তিত্ব থাকবে না, যেমন থাকবে না কাগুজে টাকার।
সোনার গহনায় অনীহা: যদি মানুষ সোনায় বিনিয়োগ না করে, তাহলে সোনার মূল্য প্রায় অর্ধেক হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাহলে বলবেন, গহনা তো মানুষ করাবেই। নারীদের গহনার প্রতি যে ভালবাসা, সে তো চিরন্তন। এ কথাও কিন্তু হলফ করে বলা খুব কঠিন। কে বলতে পারে, ১০০ বছর পর রোবটের দুনিয়ায় সুন্দরের ভাষা পাল্টে গেছে। এখন বিয়েতে যে সোনা কেনার হিড়িক রয়েছে, তখন হয়তো খুব সামান্য কিছু জিনিসই নারীদের অলঙ্কার হয়ে যাচ্ছে, যাকে বলে Minimalist Beauty। সোনার পরিবর্তে এমন অনেক ধাতু বা মাটির অলঙ্কার শোভা পেতে পারে নারীদের শরীরে।
মানুষের আয় কমে যাওয়া: এখনই AI কয়েক লক্ষ মানুষের চাকরি কেড়ে নিয়েছে। তেমনই কাজও সহজ হয়ে যাচ্ছে। তাই আগামী দিন এমন পরিস্থিতি হতেই পারে মানুষের হাতে কাজ কম। তাই আয় নেই। যদি মানুষের আয় না থাকে, তাহলে সোনা ক্রয় করবে কীভাবে?
আর একটা সহজ উপায় আছে। তাহলে সেই ঘুরেফিরে পরশ পাথরের তুলসি চক্রবর্তীর কথা আসা যাক। যদি এমন কোনও পাথর আবিষ্কার করা যায়, বা তৈরি করা যায়, যা ছোঁয়ালেই সোনা হয়ে যাবে, তাহলে আর কী! বাঙালি একদিন সত্যি সত্যি সোনার পাথরবাটিতে ভাত খাবে…


Post A Comment:
0 comments so far,add yours