তাও আবার ঘুরপথে। বিজেপিকে কাঠগড়ায় তুলে তাঁর সাফ কথা, বাংলাকে প্রথম টার্গেট করা হচ্ছে। এরপর এক এক করে বাকি সব রাজ্যকে ক্যাপচার করে নেওয়া হবে। আর এই কাজে বিহারকে সামনে রাখছে কেন্দ্র। বিজেপির কথায় কি ফের NRC চালুর চেষ্টা হচ্ছে নির্বাচন কমিশন?

আধার-ভোটার-রেশন আর কোনওটাই চলবে না!


যখন জাতীয় নাগরিকপঞ্জি বা এনআরসি নিয়ে রাজনীতি চড়েছিল, সেই সময়কালে একটা প্রশ্ন বারংবার মাথায় চাড়া দিতে দেখা গিয়েছিল, তা হল ভারতের নাগরিক কে? রাজনৈতিক মহল বলছে, এনআরসি এখন হিমঘরে। কিন্তু নাগরিকত্ব প্র্রসঙ্গ তা এখনও পিছু ছাড়েনি। বিহারে বিশেষ ও নিবিড় সমীক্ষা শুরুর পর থেকেই গোলকধাঁধায় আটকে পড়ার মতো সেই প্রশ্ন যেন আবার ভেসে উঠেছে সকলের সামনে। তবে এবার অন্য কায়দায়।

ভারতের নাগরিক কে?





যারা ভারতের বাসিন্দা। এখানে জন্মেছেন এবং তার প্রমাণপত্র রয়েছে, তারাই ভারতের নাগরিক।
যার বাবা-মায়ের জন্ম ভারতে। কিন্তু সেই ব্যক্তি নিজে এদেশে থাকেন না তবু সে ভারতের নাগরিক।
কেউ যদি ১৯৫০ সালের আগে পাকিস্তান থেকে এই দেশে চলে আসেন। তিনিও ভারতের নাগরিক।
১৯৮৭ সালের পয়লা জুলাইয়ের আগে যিনি এদেশে জন্মেছেন। কোনও রকম প্রমাণপত্র ছাড়া তিনিও ভারতের নাগরিক। তবে এই নিয়ম অসমের ক্ষেত্রে খাটে না।
অর্থাৎ ভারতের নাগরিক হওয়ার ক্ষেত্রে বর্তমান সময়ের নিরিখে জন্মপত্রটাই কার্যত ‘শেষ কথা’। আর সেই প্রসঙ্গটাই আপাতত ছিঁড়ে খাচ্ছে রাজনীতি। যার কেন্দ্রবিন্দু বিহার। সেখানে এখন সমীক্ষা চলছে। ভোটার সমীক্ষা। চলবে আর দু’দিন। তারপরেই সেই সমীক্ষার ভিত্তিতে একটি ‘পরীক্ষার ফলাফল’ প্রকাশ করবে কমিশন। যা নির্ধারণ করবে বিহারের কারা ভোটার, কারা ভোটার নয়। ‘ঘুরপথে’ নির্ধারণ করবে নাগরিকত্বের বৈধতাও।

কিন্তু কীভাবে ভোটার সমীক্ষার সঙ্গে নাগরিকত্ব জুড়ে গেল?

এক মাসের আগের কথা। ভূতুরে ভোটার নিয়ে বঙ্গ রাজনীতির আঙিনায় জুড়ে গেল নতুন প্রসঙ্গ। মমতা বললেন, NRC-এর কথা। তাও আবার ঘুরপথে। বিজেপিকে কাঠগড়ায় তুলে তাঁর সাফ কথা, বাংলাকে প্রথম টার্গেট করা হচ্ছে। এরপর এক এক করে বাকি সব রাজ্যকে ক্যাপচার করে নেওয়া হবে। আর এই কাজে বিহারকে সামনে রাখছে কেন্দ্র। বিজেপির কথায় কি ফের NRC চালুর চেষ্টা হচ্ছে নির্বাচন কমিশন?

তিনি আরও বলেন, ‘অনেক ঘাপলা আছে, বের করতে টাইম লাগবে। কিন্তু প্রথম ঘাপলাটা তো বের করে দিলাম। বাকিটা আপনারা বুঝুন।’ এর ঠিক একদিন পর বিহারে সরব হয় বিরোধীরাও। নির্বাচন কমিশনের ভোটার সমীক্ষা নিয়ে মমতার কথায় সায় দিয়ে তারা বলেন, ‘এটা আসলেই এনআরসি চেষ্টা।’ অর্থাৎ গোটা ব্যাপারটার সঙ্গে প্রথম থেকেই যেন জুড়ে গিয়েছিল নাগরিকত্ব প্রসঙ্গ। অবশ্য বিরোধীরা সুর চড়াতেই ‘নরম’ হয় কমিশন। মমতা তাদের নির্দেশিকা ধরে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘কেন মা-বাবার বার্থ সার্টিফিকেট চাইছে নির্বাচন কমিশন? গরিবেরা কীভাবে সেই শংসাপত্র পাবে?’ যার পাল্টা পরবর্তীতে কমিশন বেশ কিছু বদল ঘটায়। বিহারের ভোটারদের জন্য একটু ‘নরম’ হয় তারা। নিজেদের নির্দেশিকায় বদল এনে কমিশন জানায়,

ওয়েবাসাইটে প্রকাশিত ৪.৯ কোটি ভোটারকে আরও কোনও রকম পরিচয়পত্র বা নথি জমা দিতে হবে না।
তবে যে সকল ভোটারের নাম সেই তালিকায় নেই। অর্থাৎ ১৯৮৭ সালের পর যাদের জন্ম কিন্তু সেই বছরের তালিকায় তাদের নাম নেই। বরং রয়েছে, তাদের বাবা-মায়ের নাম, সেক্ষেত্রে ওই ব্যক্তিদের নিজস্ব পরিচয়পত্র প্রদান করলেই হবে। আলাদা কোনও প্রমাণপত্র লাগবে না।
নাগরিকত্ব যায় না ঘুঁচে

সুর নরম হয়। সমীক্ষা সচল হয়। কিন্তু নাগরিকত্ব প্রসঙ্গটা জুড়ে থাকে। কারণ একটাই, কমিশন পরবর্তী সময়ে প্রকাশিত নির্দেশিকাগুলিতে ‘বিশেষ ছাড়’ দিলেও একটা বিষয় অপরিবর্তীত রাখে। তা হল ডিক্লারেশন ফর্মে নাগরিকত্বের প্রমাণপত্র হিসাবে জন্ম শংসাপত্রকে অগ্রাধিকার। যার ভিত্তিতে শীর্ষ আদালতে সমীক্ষায় স্থগিতাদেশের দাবিতে মামলা করেন তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র-সহ বেশ কয়েকজন।

গত ১০ই জুলাই ছিল সেই মামলার শুনানি। বিচারপতি সুধাংশু ধুলিয়া এবং বিচারপতি জয়মাল্য বাগচীর বেঞ্চে ওঠে সেই মামলা। সেখানেই কমিশন জানায়, আধার কার্ড পরিচয় প্রমাণ হিসাবে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু অন্য বিষয়ের জন্য তার ব্যবহার সীমীত। আধার কার্ড নাগরিকত্বের প্রমাণ নয়। তবে পরিচয়ের প্রমাণ।

কমিশনের দাবি শোনার পর আদালতের পর্যবেক্ষণ, এই সমীক্ষায় স্থগিতাদেশের কোনও প্রয়োজন নেই। কিন্তু কমিশনের আধার, ভোটার ও রেশন কার্ডকে সমীক্ষার নথি হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। অর্থাৎ বিহারে যে সমীক্ষা চালাচ্ছে তারা। সেখানে ১১টি নথির মধ্য়ে এই আধার-ভোটার-রেশন কার্ডকে রাখার পরামর্শ দেয় আদালত।

দিন কাটে। কিন্তু কমিশন নিজের অবস্থান জানায় না। এরপর অবশেষে মঙ্গলবার এই নিয়ে শীর্ষ আদালতে একটি হলফনামা জমা দেয় তারা। যা আবার নতুন করে উস্কে দেয় নাগরিকত্ব ইস্যুকে। সেই হলফনামায় তারা জানায়, সংশোধিত ভোটার তালিকায় নাম তোলার জন্য আধার, ভোটার কিংবা রেশন কার্ড গণ্য় হবে না। এই কথা আগেই জানিয়েছিল তারা। তবে এবার এর সপক্ষে যুক্তি তুলে ধরতে দেখা গেল তাদের।

কমিশন জানিয়েছে, সারা দেশে প্রচুর ভুয়ো রেশন কার্ড রয়েছে। সুতরাং, তার উপর ভিত্তি করে ভোটার তালিকা সংশোধন সম্ভব নয়। আর এই ভুয়ো ব বোগাস রেশন কার্ড ভিত্তি করে তৈরি হচ্ছে অবৈধ আধার কার্ড। অতএব সেটির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। এমনকি, ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসের পর থেকে যে আধার কার্ডগুলি দেওয়া হয়েছে, সেখানে এই সংক্রান্ত বিষয়ে স্পষ্ট সতর্কীকরণ রয়েছে বলেও হলফনামায় উল্লেখ করেছে কমিশন। ভোটার কার্ডে তোলা আপত্তির ক্ষেত্রে তাদের যুক্তি, কোনও এক ব্যক্তির এপিক বা ভোটার কার্ড, তার বর্তমান অবস্থার প্রতিচ্ছবি। অর্থাৎ সেই ব্যক্তি কমিশনের চোখে ভোটার। কিন্তু তিনি কীভাবে ভোটার হলেন? বৈধ নাকি অবৈধ পথে? সেই উত্তর ভোটার কার্ড দিতে পারে না। সেহেতু এটিকেও গণ্য করা হবে না।

তা হলে কি প্রমাণ করবে কেউ ভারতের নাগরিক কিনা? জোর সেই জন্ম শংসাপত্রেই। শুধু তাই নয়, কমিশন একথা উল্লেখ করে যে কোনও ব্যক্তির ভোটার হওয়ার জন্য সাংবিধানিক রূপরেখা অনুযায়ী তার নাগরিকত্ব বৈধ কিনা তাও খতিয়ে দেখার দায়বদ্ধতা ও সাংবিধানিক অধিকার নির্বাচন কমিশনের রয়েছে। তবে ভোটার হতে না পারলে তার নাগরিকত্ব চলে যাবে এমনটাও নয়। অর্থাৎ গোলকধাঁধায় আবার চোখের সামনে প্রসঙ্গ নাগরিকত্ব।
Share To:

kakdwip.com

Post A Comment:

0 comments so far,add yours