বছর ঘুরলেই রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। আগের দুটি বিধানসভা নির্বাচনে একসঙ্গে লড়াই করেছে বাম-কংগ্রেস। আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে সেই ছবি কি দেখা যাবে? শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস ও প্রধান বিরোধী দল বিজেপিকে টক্কর দিতে কি অধীর চৌধুরী, শুভঙ্কর সরকারদের হাত ধরবেন বিমান বসু-মহম্মদ সেলিমরা? পড়ুন টিভি৯ বাংলার বিশেষ প্রতিবেদন...

 বিধানসভা নির্বাচনে বাম-কংগ্রেস আসন সমঝোতার হ্যাটট্রিক হবে? কেন ছিঁড়তে পারে 'বন্ধন'?
কী বলছেন মহম্মদ সেলিম?


একসময়ের যুযুধান দুই পক্ষ। বাংলায় রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে এখন তারা কাছাকাছি। তবে দুই পক্ষের কাছাকাছি আসাকে ‘জোট’ বলতে রাজি নন বামফ্রন্ট চেয়ারম্য়ান বিমান বসু। তাঁর মতে, এটা আসন সমঝোতা। যেটা ২০১৬ এবং ২০২১ সালে বিধানসভা নির্বাচনের সময় দেখা গিয়েছে। আবার ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনেও প্রত্যক্ষ করেছেন বাংলার ভোটাররা। বছর ঘুরলেই রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। ছাব্বিশের নির্বাচনে বাম-কংগ্রেসের মধ্যে সেই আসন সমঝোতা কি দেখা যাবে? শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস ও প্রধান বিরোধী দল বিজেপিকে টক্কর দিতে কি অধীর চৌধুরী, শুভঙ্কর সরকারদের হাত ধরবেন বিমান বসু-মহম্মদ সেলিমরা? অধীর চৌধুরীর জায়গায় প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি পদে শুভঙ্কর সরকার আসায় দুই দলের আসন সমঝোতা কি ধাক্কা খেতে পারে?বাংলার রাজনৈতিক মহলে এই নিয়ে জল্পনা ও চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে।


২০১১ সালে তৃণমূলের সঙ্গী কংগ্রেসই ২০১৬-য় হাত ধরে বামেদের-

১৯৭৭ সাল থেকে ২০১১। ৩৪ বছর রাজ্যে ক্ষমতায় ছিল বামেরা। বামফ্রন্ট সরকারের প্রথম ২০ বছর সিপিএমের প্রধান প্রতিপক্ষ ছিল কংগ্রেস। হাত শিবির ছেড়ে ১৯৯৮ সালে তৃণমূল কংগ্রেস গঠন করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ধীরে ধীরে বামেদের প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে তৃণমূল। তবে লড়াইয়ে দেখা যায় কংগ্রেসকে। বিশেষ করে মালদহ, মুর্শিদাবাদের মতো জেলায় কংগ্রেসের ভিত তখন যথেষ্ট শক্ত। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ২০০৭ সাল থেকে বাংলায় পরিবর্তনের হাওয়া উঠতে শুরু করে। ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে যার স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এই নির্বাচনে কংগ্রেস ও তৃণমূল জোট বেঁধেছিল। তাদের সঙ্গে ছিল এসইউসিআই। তৃণমূল পেয়েছিল ১৯টি আসন, কংগ্রেস ৬টি ও এসইউসিআই একটি আসন পায়। আর বামেরা পায় ১৫টি আসন।

২০১১ সালে রাজ্যে পরিবর্তন হয়। আর সেই পরিবর্তনে তৃণমূলের সঙ্গী হয়েছিল কংগ্রেস। বামফ্রন্টকে হারাতে জোট বেঁধেছিল তারা। আর এই জোট-ই ৩৪ বছরের বাম সরকারের অবসান ঘটায় বাংলায়।

তবে রাজ্যে সরকার গঠনের পর কংগ্রেস-তৃণমূলের জোট বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ২০১১ সালে রাজ্যে যখন তৃণমূলের নেতৃত্বে সরকার গঠন হয়, সেইসময় কেন্দ্রে ছিল কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার। বাংলায় তৃণমূলের নেতৃত্বাধীন সরকারে কংগ্রস। আর কেন্দ্রে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন জোট সরকারে তৃণমূল। ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ-সহ একাধিক ইস্যুতে ইউপিএ সরকার থেকে বেরিয়ে আসে তৃণমূল। স্বাভাবিকভাবেই রাজ্যেও তৃণমূল নেতৃত্বাধীন সরকার থেকে বেরিয়ে যায় কংগ্রেস।

তারপর মাত্র ৩ বছরেই রাজ্যে রাজনৈতিক জোটের হাত-বদল দেখতে পাওয়া যায়। যে বামফ্রন্ট সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরাতে তৃণমূলের সঙ্গে জোট করেছিল কংগ্রেস, সেই বামেদের সঙ্গেই ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে আসন সমঝোতা করে কংগ্রেস।

২০১৬ এবং ২০২১ সালে বিধানসভা নির্বাচনে বাম-কংগ্রেস ‘জোট’-

২০১১ সাল পর্যন্ত প্রতিপক্ষ। ২০১৬ সালে সেই দুই প্রতিপক্ষ বাম ও কংগ্রেস জোট (যদি বামেদের বক্তব্য, এটা আসন সমঝোতা) করে তৃণমূলকে পরাস্ত করতে। আর এই জোটের পথ প্রশস্ত করেছিল ২০১৫ সালে শিলিগুড়ি পৌরনিগমের ভোট। সেইসময় স্থানীয় স্তরে কংগ্রেস ও বামেরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল তৃণমূলকে পরাস্ত করতে। শিলিগুড়ি মডেল সফলও হয়। ২০১৬ সালের নির্বাচনের আগে যা দুই দলকে আসন সমঝোতায় উৎসাহিত করেছিল বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন। তবে বিধানসভা নির্বাচনে আশানুরূপ ফল করতে পারেনি বাম-কংগ্রেস। তাদের ‘জোট’ ৭৭টি আসন পায়। তার মধ্যে কংগ্রেস জেতে ৪৪টি আসনে।

উনিশের লোকসভায় আসন সমঝোতা না হলেও একুশে ফের হাত ধরল বাম-কংগ্রেস

২০১৬ সালের নির্বাচনে আশানুরূপ ফল না হওয়ার পর উনিশের লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস ও বামেদের মধ্যে কোনও আসন সমঝোতা হয়নি। তবে একুশের বিধানসভা নির্বাচনের আগে ফের কাছাকাছি আসে কংগ্রেস ও বামেরা। সেইসময় প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী। আর সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র। আসন সমঝোতা করে ভোটে লড়ল তারা। তাদের সঙ্গে যোগ দিল রাজনীতির মঞ্চে সদ্য আত্মপ্রকাশ করা আইএসএফ। কিন্তু, বাম ও কংগ্রেস একটিও আসন পেল না। আইএসএফ একটি আসন পেল।

বাম-কংগ্রেসের সাগরদিঘি মডেল-

একুশের নির্বাচনে একটি আসন না জিতলেও বছর দুয়েকের মধ্যেই বাম-কংগ্রেসের মুখে হাসি ফোটাল মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘির উপনির্বাচন। সাগরদিঘির তৃণমূল বিধায়ক সুব্রত সাহার প্রয়াণে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারির শেষে এই আসনে উপনির্বাচন হয়। সেখানে কংগ্রেস প্রার্থীকে সমর্থন করে বামেরা। আর ভোটে কংগ্রেসের প্রার্থী বাইরন বিশ্বাস জয়ী হন। সাগরদিঘি মডেল নিয়ে রাজ্য রাজনীতিতে জোর আলোচনা শুরু হয়। যদিও বাইরন বিশ্বাস কয়েকমাসের মধ্যেই তৃণমূলে যোগ দেন।

চব্বিশের লোকসভায় আসন সমঝোতা বাম-কংগ্রেসের

উনিশের লোকসভা নির্বাচনে বাম ও কংগ্রেস আলাদা লড়লেও চব্বিশের নির্বাচনে তারা পরস্পরের হাত ধরে। চব্বিশের নির্বাচনে এই আসন সমঝোতার অন্য তাৎপর্যও রয়েছে। কেন্দ্রের মোদী সরকারকে পরাস্ত করতে ২০২৩ সালে বিরোধীরা ইন্ডিয়া জোট তৈরি করে। সেই জোটে বাম, কংগ্রেস ও তৃণমূল রয়েছে। কিন্তু, রাজ্যে তৃণমূলের বিরুদ্ধে সরব হতে দেখা যায় বাম ও কংগ্রেস নেতাদের। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী তৃণমূলের বিরুদ্ধে লাগাতার আক্রমণ শানান। প্রথমে তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কংগ্রেসকে দুটি আসন ছাড়তে চেয়েছিলেন। কংগ্রেস তাতে রাজি ছিল না। তারপর কংগ্রেস ও তৃণমূলের মধ্যে জোট নিয়ে কথাবার্তা এগোয়নি। কিন্তু, বাম ও কংগ্রেস নেতাদের একই মঞ্চে একাধিকবার দেখা যায়। শেষপর্যন্ত তারা আসন সমঝোতা করে লড়াই করে। চব্বিশের নির্বাচনে রাজ্যে কংগ্রেস একটি আসন পেলেও বামেরা কোনও আসন জিততে পারেনি।

প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি বদলের পর বাম-কংগ্রেসের জোট নিয়ে জল্পনা-

লোকসভা নির্বাচনের সময় তৃণমূলের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন অধীর চৌধুরী। যার পাল্টা তৃণমূল বলেছিল, অধীরের জন্যই কংগ্রেসের সঙ্গে রাজ্যে তাদের জোট হয়নি। লোকসভা নির্বাচনে অধীর নিজে বহরমপুরে হেরেছেন। যেখানে ১৯৯৯ সাল থেকে সাংসদ ছিলেন তিনি। লোকসভা নির্বাচনের পর গত বছরের সেপ্টেম্বরে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি পদ থেকে সরানো হয় তাঁকে। প্রদেশ সভাপতি হন শুভঙ্কর সরকার। তৃণমূলের প্রতি অধীরের মতো তিনি সরব নন বলেই রাজনৈতিক মহলের বক্তব্য।

আর শুভঙ্কর প্রদেশ কংগ্রেসের দায়িত্ব পাওয়ার পর নভেম্বরে রাজ্যে ৬টি বিধানসভা আসনে উপনির্বাচন হয়। সেখানে বামেদের সঙ্গে তাদের আসন সমঝোতা হবে কি না, তা নিয়ে জল্পনা তৈরি হয়েছিল। শেষপর্যন্ত আসন সমঝোতা হয়নি। তারপরই প্রশ্ন উঠতে শুরু করে, ভবিষ্যতে কি আর বাম-কংগ্রেস একসঙ্গে ভোটে লড়বে না রাজ্যে?

কালীগঞ্জে উপনির্বাচনে ফের কাছাকাছি বাম-কংগ্রেস

বাম-কংগ্রেসের ‘জোটের’ ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন প্রশ্ন উঠছে, তখনই কালীগঞ্জ বিধানসভার উপনির্বাচনে তাদের একসঙ্গে দেখা গেল। আগামী ১৯ জুন কালীগঞ্জে উপনির্বাচন। সেখানে কংগ্রেস প্রার্থীকে সমর্থন জানিয়েছে বামেরা। ফলে বাম-কংগ্রেসের আসন সমঝোতার রাস্তা যে একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি, তার প্রমাণ মিলেছে।

ছাব্বিশে কি বাম-কংগ্রেস আসন সমঝোতা দেখা যাবে? কী বললেন সেলিম?

বছর ঘুরলেই রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। আগের দুটি বিধানসভা নির্বাচনে একসঙ্গে লড়াই করেছে বাম-কংগ্রেস। আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে সেই ছবি কি দেখা যাবে?

আবার গত কয়েকমাসে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ইস্যুতে কংগ্রেস ও তৃণমূলকে কাছাকাছি আসতে দেখা গিয়েছে। অধীরও আর প্রদেশ সভাপতি নন। ফলে ২০১১ সালের মতো কংগ্রেস ও তৃণমূল রাজ্যে জোট করবে কি না, তা নিয়েও জল্পনা ছড়িয়েছে।

ছাব্বিশে কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতা নিয়ে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলছেন, “কালীগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্রে উপনির্বাচনে কংগ্রেস প্রার্থীকে সমর্থনের জন্য কংগ্রেসের তরফে ফোন করা হয়েছিল। বামেরা কংগ্রেস প্রার্থীকে সমর্থন করেছে। ওরা যুক্তি দেয়, ছাব্বিশের নির্বাচনের আগে আমরা নিজেদের মধ্যে অযথা কেন তিক্ততা বাড়াব। একুশের নির্বাচনে যেহেতু ওরা বামফ্রন্টের সমর্থনে লড়েছিল, সেটাই চালিয়ে যেতে চায়। একুশ থেকে পঁচিশ ওরা কন্টিনিউ করতে চায়। আর পঁচিশ থেকে ছাব্বিশে ওরা কোথায় যাবে, সেটা ওরা ঠিক করবে। কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত তো আমরা নিতে পারব না। ”

রাজনীতির কারবারিরা বলছেন, ঠিকই বলেছেন সেলিম। কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত কংগ্রেসকেই নিতে হবে। তবে তাঁরা কী করতে চান, তা নিয়ে স্পষ্ট কোনও বার্তা দেননি সেলিম। ছাব্বিশের জোট নিয়ে কংগ্রেস কোনও স্পষ্ট বার্তা এখনও দেয়নি। এখন দেখার, বাম-কংগ্রেসের আসন সমঝোতার হ্যাটট্রিক হয় কি না।
Share To:

kakdwip.com

Post A Comment:

0 comments so far,add yours