মায়ানমারে মানবিক করিডর, বাংলাদেশের বিপদ বাড়িয়ে কেন ‘নোবেল’ সাজতে চাইছেন ইউনূস?
বিএনপি সহ বিভিন্ন দলের নেতারা অন্তর্বর্তী সরকারের এক্তিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তারা বলছেন, অনির্বাচিত ও অরাজনৈতিক সরকার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, এটা হতে পারে না। মায়ানমারে ত্রাণ পাঠানোর জন্য চ্যানেল বা করিডর- যাই-ই শব্দ ব্যবহার করা হোক না কেন, এতে বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা প্রশ্নের মুখে পড়বে।
মায়ানমারে মানবিক করিডর, বাংলাদেশের বিপদ বাড়িয়ে কেন 'নোবেল' সাজতে চাইছেন ইউনূস?
ঘরে-বাইরে বিপদ ইউনূসের। একদিকে নির্বাচন নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের উপরে চাপ বাড়ছে, তার উপরে নতুন করে অস্বস্তি বাড়ছে রাখাইন মানবিক করিডর নিয়ে। মায়ানমারের রাখাইন রাজ্য়ে ত্রাণ সাহায্য পৌঁছে দেওয়ার জন্য মানবিক করিডর তৈরির কথা বলেছে রাষ্ট্রপুঞ্জ। এই পথ তৈরি করতে হবে বাংলাদেশ দিয়ে। কিন্তু তাতে বাংলাদেশের কী লাভ? এই প্রশ্নই তুলেছে রাজনৈতিক দলগুলি। বেঁকে বসেছে তারা। ফলে ফাঁপরে পড়েছেন মহম্মদ ইউনূস। না তিনি রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রস্তাব ফেরাতে পারছেন, না দেশের বিপক্ষে গিয়ে মানবিক করিডরে সম্মতি জানাতে পারছেন!
মানবিক করিডর কী, কেন মায়ানমারে এই করিডর তৈরির কথা বলা হচ্ছে, তাতে বাংলাদেশের এত মাথাব্য়থা কেন, এই সব বিষয় বোঝার আগে সে দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে একটু জানা দরকার। পূর্বের ব্রহ্মদেশ হল এই মায়ানমার। ৫ কোটির বাসিন্দার এই দেশে বারবার সেনার শাসন হয়েছে। ১৯৮৮ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত সেনাই ক্ষমতায় ছিল। পরে সরকার নির্বাচিত হয়, তৈরি হয় সংবিধান। ২০১৫ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসে আন সু কি সরকার। তবে পুলিশ ও সেনার নিয়ন্ত্রণ ছিল জুন্টা বাহিনীর হাতেই।
মায়ানমারের অন্যতম সমস্যা রোহিঙ্গা ইস্যু। ২০১৭ সাল থেকে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে প্রবল অত্য়াচার শুরু করে সেনা। সব দেখেও চুপ থাকে আন সু কি সরকার। রাষ্ট্রপুঞ্জের মঞ্চে এই নিয়ে চরম সমালোচনার মুখেও পড়ে সু কি সরকার। ২০১৮ সালে প্রায় ৭ লক্ষ রোহিঙ্গা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। একটা বড় অংশই আশ্রয় নেন বাংলাদেশে। কক্সবাজারে বিশ্বের সবথেকে বড় অস্থায়ী রোহিঙ্গা ক্যাম্প রয়েছে।
রোহিঙ্গা মাথাব্যথা-
২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি জুন্টা বাহিনী ফের মায়ানমার দখল নেয়। সামরিক অভ্যুত্থানের মুখে সু কি গ্রেফতার হন, ফের সামরিক শাসনের সূত্রপাত হয়। মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশে মূলত বসবাস ছিল রোহিঙ্গাদের। সঙ্গে বসবাস বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদেরও। কার্যত ‘এথনিক ক্লিনসিং’ করা হয়। উৎখাত করা হয় রোহিঙ্গা মুসলিমদের। বাংলাদেশ এই রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করলেও বর্তমানে তা গলার কাটা হয়ে গিয়েছে।
এরই মধ্য়ে আরও মাথাব্যথা বাড়িয়েছে আরাকান আর্মি। মায়ানমারের এই বিদ্রোহী গোষ্ঠী ক্ষমতা কাড়ছে জুন্টা বাহিনীর হাত থেকে। মায়ানমারের একের পর এক প্রদেশ দখল করছে তারা। এমনকী বাংলাদেশের ভূখণ্ডের ১০ কিলোমিটার ভিতরে ঢুকে পড়ে আরাকান আর্মি। আগেও সীমান্তে গুলিবর্ষণ এবং বাংলাদেশি নাগরিকদের অপহরণের অভিযোগ উঠেছে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে। এই আরাকান আর্মির দখলেই রয়েছে মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশ। তবে এর বন্দর সিট্টের দখল এখনও জুন্টার হাতেই।
মানবিক করিডরের প্রসঙ্গ এল কীভাবে?
মায়ানমারের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে রাষ্ট্রপুঞ্জ। গত বছর নভেম্বরে রাষ্ট্রপুঞ্জ উন্নয়ন কর্মসূচিতে রাখাইন রাজ্য নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, তাতে বলা হয়, মায়ানমারে দুর্ভিক্ষ আসন্ন। এই প্রেক্ষাপটেই মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বাংলাদেশ সফরে আসেন রাষ্ট্রপুঞ্জের জেনারেল সেক্রেটারি আন্তেনিও গুতেরাস। সেই সময়ই মায়ানমারে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দেওয়ার জন্য মানবিক করিডর তৈরির প্রস্তাব দেওয়া হয়। যেহেতু বন্দর দিয়ে ঢোকা প্রায় অসম্ভব, তাই বাংলাদেশে মানবিক করিডরের প্রস্তাব দেওয়া হয়, কারণ মায়ানমারের রাখাইনের সঙ্গে সীমান্ত ভাগ করে বাংলাদেশ।
এরপর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা বিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ ও নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমানের মুখেও মানবিক সহায়তা চ্যানেল বা মানবিক করিডরের কথা শোনা যায়। গত ২৭ এপ্রিল পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনও বলেন, ‘মানবিক প্যাসেজ দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকার ‘নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’
কীভাবে হবে মানবিক করিডর?
মায়ানমারে জুন্টা বাহিনীর সঙ্গে কথা বলে বিশেষ সুবিধা করা যায়নি। গাজার মতো পরিস্থিতি যাতে মায়ানমারে না হয়, তাই বিশেষ করিডর তৈরি করে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। এই প্রস্তাবে বলা হয়, বাংলাদেশের সীমান্তপথ ব্যবহার করেই মায়ানমারে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া হবে। এই প্রস্তাবে সম্মতিও জানিয়েছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার। আর এরপরই যাবতীয় বিরোধ।
রাষ্ট্রপুঞ্জ সম্প্রতি বিবৃতি দিয়ে বলেছে, ত্রাণ সহায়তা পাঠানোর জন্য মায়ানমারের সরকার এবং রাখাইনের নিয়ন্ত্রণে থাকা আরাকান আর্মি, এই দুটি পক্ষের সম্মতির প্রয়োজন। অর্থাৎ বাংলাদেশকেই এই কথা বলতে হবে।
করিডর নিয়ে আপত্তি কোথায়?
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রস্তাবে সম্মতি জানালেও, আপত্তি জানিয়েছে রাজনৈতিক দল থেকে সেনাবাহিনী। ক্রমশ চাপ বাড়ছে সরকারের উপরে। সরকারও নিজেদের যুক্তি-অবস্থান স্পষ্ট করতে পারছে না। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান বারবার কথা বদল করছেন। একবার করিডরের কথা বলেছেন, আবার নিজেই বলেছেন, করিডর নিয়ে সরকার কারও সঙ্গে কোনও কথা বলেনি এবং বলবেও না। তার বক্তব্য়, “মানবিক করিডর হচ্ছে একটা জরুরি সময়ে দুর্যোগপূর্ণ জায়গা থেকে মানুষকে সরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা। এখানে কাউকে সরানো হচ্ছে না। যেটা করা হচ্ছে তাতে এখানে ত্রাণসামগ্রী ও উপকরণ অন্য রুটে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। জাতিসংঘ আমাদের এতটুকু বলেছে, পণ্যটি বাংলাদেশের সীমান্ত দিয়ে রাখাইনে নেওয়ার জন্য।”
নিজের বিপদ নিজে ডাকছে বাংলাদেশ?
মায়ানমারের জুন্টা সরকার ও আরাকান আর্মির মধ্য়ে সংঘাত চরমে। এই সংঘাতের মাঝে ঢুকে করিডর তৈরি করার অর্থ হল অনাকাঙ্ক্ষিত যুদ্ধের মুখোমুখি হওয়া। বাংলাদেশের সীমান্ত ব্যবহার করা হলে,দেশের জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। ভয়, এই করিডর তৈরি করা হলে, বাংলাদেশে আরও অনুপ্রবেশ বাড়বে। বিশেষ করে রোহিঙ্গা সমস্যা আরও বাড়বে। এই করিডর ব্য়বহার করে ত্রাণ সামগ্রীর সঙ্গে সঙ্গে আরাকান আর্মির হাতে অস্ত্রশস্ত্রও পৌঁছে দেওয়া হবে। এতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বাংলাদেশেরই বিপদ বাড়বে।
আপত্তি সেনারও-
বাংলাদেশের সেনাও করিডর নিয়ে ইউনূস সরকারের সিদ্ধান্ত ক্ষুব্ধ। এই সিদ্ধান্ত কোনও অন্তর্বর্তী সরকার নিতে পারে না, একমাত্র নির্বাচিত সরকারেরই অধিকার আছে, তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন সেনা প্রধান ওয়াকার-উজ-জামান। তাদের যুক্তি হল, সীমান্তে করিডর তৈরি হলে নিরাপত্তার দায়িত্ব তাদেরই নিতে হবে। সেক্ষেত্রে বিনা কারণে সংঘাতে জড়াতে হবে তাদের।
আসল ফন্দি কী?
রাষ্ট্রপুঞ্জ চলে আমেরিকার অর্থ সাহায্যে। করিডর তৈরি হলে, আমেরিকা যে নাক গলাবে না, এ কথা কেউ গ্য়ারান্টি দিয়ে বলতে পারে না। মায়ানমারে যে খনিজের ভাণ্ডার রয়েছে, তাতে কুনজর রয়েছে আমেরিকা, দক্ষিণ কোরিয়া সহ একাধিক দেশের। অন্যদিকে, চিনের সঙ্গে আবার মায়ানমারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। তারাও ওৎ পেতে আছে মায়ানমারে ঢুকে তাদের খনিজ সম্পদ দখল নেওয়ার জন্য। এমনটাই মত কূটনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের।
কী বলছে রাজনৈতিক দলগুলি?
বিএনপির দাবি, সরকারের কেউ ব্যক্তিস্বার্থ থেকে এবং দেশের বাইরের কোনও পক্ষ থেকে বাংলাদেশের সীমান্তে অস্থির পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখা উচিত। দেশে যেখানে নির্বাচনের প্রয়োজন আগে, সেখানে কেন অন্য় দেশের বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে।
রাজনৈতিক-কূটনীতিকদের কথায়, এমন স্পর্শকাতর বিষয়ে রাজনৈতিক দল সহ সব অংশের ঐকমত ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকার এভাবে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।
বিরোধীদের কথাও যুক্তিযুক্ত। বিএনপি সহ বিভিন্ন দলের নেতারা অন্তর্বর্তী সরকারের এক্তিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তারা বলছেন, অনির্বাচিত ও অরাজনৈতিক সরকার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, এটা হতে পারে না। মায়ানমারে ত্রাণ পাঠানোর জন্য চ্যানেল বা করিডর- যাই-ই শব্দ ব্যবহার করা হোক না কেন, এতে বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা প্রশ্নের মুখে পড়বে। এমন স্পর্শকাতর বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।
জুন্টা ও আরাকান আর্মির সঙ্গে কথা বলার যে শর্ত দিয়েছে রাষ্ট্রপুঞ্জ, সে প্রসঙ্গ টেনেও বিএনপির এক নেতা বলেছেন যে জুন্টা সরকার সম্মতি দিচ্ছে না, রাষ্ট্রপুঞ্জও এগোচ্ছে না, তাহলে অন্তর্বর্তী সরকার কেন এই করিডর তৈরির বিবেচনা করছে? বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সেই কারণেই গত ২৩ এপ্রিলে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশকে গাজা বানানোর চক্রান্ত চলছে’।
জামাতেরও বক্তব্য, বাংলাদেশের সীমান্ত বা ভূখণ্ড অন্য কারও ব্যবহারের প্রশ্নে নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। রাজনৈতিক ঐকমত্য ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। এনসিপি বলছে, সীমান্ত ব্যবহার করে ত্রাণ চ্যানেল বা পাথওয়ে হিসেবে যে ধরনের উদ্যোগের কথা বলা হচ্ছে, তার প্রত্যেকটা বিষয়ে স্বচ্ছতা প্রয়োজন। রাজনৈতিক দলগুলোকে আঁধারে রেখে এটা করা যাবে না।
এত বিতর্ক যখন, তাহলে জোর করছেন কেন ইউনূস?
রাখাইনে চ্যানেল, পাথওয়ে নাকি করিডর তৈরি হবে, তা নিয়ে কোনও স্পষ্ট ব্যাখ্যা দিচ্ছে না বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার। তাই বিতর্কও বেড়ে চলেছে। তবে অনেকেরই প্রশ্ন, গোটা দেশ যেখানে বিপক্ষে, তাহলে কেন করিডর তৈরি করতে চান ইউনূস? এক্ষেত্রে অনেকেই যুক্তি দিচ্ছেন, শান্তিতে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত মহম্মদ ইউনূস নিজের ভাবমূর্তি ধরে রাখতে চাইছেন। যদি তিনি সাহায্যের হাত না বাড়ান, তাহলে তার ভাবমূর্তি নষ্ট হবে। সেই জন্যই এত জোরাজুরি।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours