সন থেকে একেবারে পায়ের তলায়! ১২ বছরে যা হল না, ১২ দিনে সম্ভব হল কীভাবে!
Syria: দামাস্কাসে সাধারণ মানুষের সেলিব্রেশন।
বাসার আল-আসাদের প্রাসাদে ঢুকে লুঠপাট। আসাদ ও তাঁর বাবার মূর্তি ভাঙা। এসব দেখতে দেখতে আমার মার্কেজের লেখার কথাই মনে পড়ে গেল।
সিংহাসন থেকে একেবারে পায়ের তলায়! ১২ বছরে যা হল না, ১২ দিনে সম্ভব হল কীভাবে!
১৯৭৫ সালে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ লিখেছিলেন তাঁর অমর উপন্যাস ‘দ্য অটম অব পেট্রিয়ার্ক’ (The Autumn of the Patriarch)। সেখানে ছিল এক স্বৈরশাসকের পতনের কথা। ‘সপ্তাহের শেষে শকুনেরা সব জানালা গলে ঢুকে পড়ে রাষ্ট্রপতির প্রাসাদের ভিতরে উড়ে বেড়াতে লাগল…। আর সোমবার ভোরে শহরটা তার শত বছরের আলস্য ঝেড়ে ফেলে একটা নরম-মৃদু বাতাসে জেগে উঠল।’ Autumn of the Patriarch-এর প্রথম বাক্যটা যদি বাংলা তর্জমা করি, তাহলে তা অনেকটা এমনই দাঁড়ায়।
স্পেনের ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কো, কলম্বিয়ার গুস্তাভো পিনিল্লা আর ভেনেজুয়েলার হুয়ান গোমেজ। বাস্তবের এই তিন ডিক্টেটরকে দেখে মার্কেজ তাঁর উপন্যাসটি লিখেছিলেন। মার্কেজের পথ চলা ছিল ম্যাজিক রিয়ালিজম বা জাদু বাস্তবতায়। তবে দোর্দণ্ডপ্রতাপ শাসককে বাস্তবে দুনিয়া বারবার দেখেছে সিংহাসন থেকে ধুলোয় এসে ছিটকে পড়তে।
দামাস্কাসে সাধারণ মানুষের সেলিব্রেশন। বাসার আল-আসাদের প্রাসাদে ঢুকে লুঠপাট। আসাদ ও তাঁর বাবার মূর্তি ভাঙা। এসব দেখতে দেখতে আমার মার্কেজের লেখার কথাই মনে পড়ে গেল। আর কী সমাপতন বলুন তো। রবিবারই দামাস্কাসের দখল নিল বিদ্রোহীরা। প্রেসিডেন্ট বাসার অল-আসাদ রাশিয়া পালালেন। আর সোমবার সারা দিন দামাস্কাস-সহ সিরিয়ার সর্বত্র চলল সেলিব্রেশন।
বাসার আল-আসাদের বাবা হাফিজ আল-আসাদ ৩০ বছর সিরিয়া শাসন করেন। বাবার মৃত্যুর পর ২০০০ সালে মাত্র ৩৪ বছর বয়সে গদিতে বসেন বাসার। যদিও, গোড়ায় তাঁর রাজনীতিতে আসার ইচ্ছেই ছিল না। লন্ডনে ডাক্তারি পড়তেন। রক গানের ভক্ত ছিলেন। আর লন্ডনেরই কিংস কলেজের লিটারেচারের ছাত্রী আসমার সঙ্গে চুটিয়ে প্রেম করতেন। তাঁকেই বিয়ে করেন।
হাফিজ মারা যাওয়ার পর দেশে একটা রাজনৈতিক শূন্যস্থান তৈরি হয়। লন্ডনের পাট চুকিয়ে সিরিয়ায় ফিরে শাসক হয়ে যান বাসার। ক্ষমতা হাতে নিয়েই সরকারি ব্যবস্থায় স্বজনপোষণ বন্ধ করেন। আর্থিক সংস্কার করেন। সমাজে খোলা হাওয়া নিয়ে আসেন। শুরুতে তাঁকে নিয়ে খুশিই ছিলেন সাধারণ মানুষ। তবে, কিছুদিনের মধ্যেই স্বৈরাচারী হয়ে ওঠেন বাসার। সরকারের বিরুদ্ধে মুখ খুললে খুন হয়ে যাওয়াটাই সিরিয়ায় রেওয়াজ হয়ে দাঁড়ায়। পরিণামে ২০১২ সাল থেকেই শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। মারা যান ৫ লক্ষের বেশি মানুষ। সিরিয়ার প্রায় অর্ধেক বাসিন্দা ঘরছাড়া হন।
২০১৩ সালে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগ ওঠে আসাদের বিরুদ্ধে। সিরিয়ায় রয়েছে কুখ্যাত সৈদনায়ার জেল। এই সৈদনায়ার জেল ছিল আসাদের গুমঘর। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্ট বলছে এই জেলে প্রায় ১৫ হাজার মানুষকে চরম নির্যাতন করে খুন করা হয়। পুরুষ বন্দিদের গান পয়েন্টে রেখে তাঁদের দিয়ে মহিলা বন্দিদের ধর্ষণ করানো হত। প্রতি সপ্তাহে একদিন কম করে ২০ জন কয়েদিকে একসঙ্গে গণফাঁসি দেওয়া হত। জেলে এই দিনটাকে বলা হত পার্টি ডে।
আজ বিদ্রোহীরা সৈদনায়ার জেল ভেঙে বন্দিদের মুক্ত করছেন। গত ১২ বছর ধরেই তো গৃহযুদ্ধ চলছে। আসাদকে ফেলার চেষ্টা করছিলেন বিদ্রোহীরা। যেটা ১২ বছরে হল না, সেটা গত ১২ দিনে কী করে সম্ভব হল!
বিদ্রোহীরা এই দফায় ঠিক ১২ দিনের যুদ্ধেই দামাস্কাস দখল করেছেন। সম্ভব হল তার কারণ, আসাদের এক বন্ধু রাশিয়া, ইউক্রেনে ব্যস্ত। আর দুই বন্ধু ইরান ও লেবানন ইজরায়েলকে নিয়ে ব্যস্ত। বিদ্রোহীরা ঝোপ বুঝেই কোপ মারলেন। বিপদের দিনে আসাদ আর কাউকে পাশে পেলেন না।
আসাদের কথা যখন বলছি তখন আরেকজনের কথাও আপনাদের বলতেই হচ্ছে। তিনি এই অভ্যুত্থানের নায়ক আবু মহম্মদ আল গোলানি। মূলত দুটো সশস্ত্র গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম এবং জইশ আল-ইজ্জা সিরিয়ার সরকারি সেনাকে হারিয়ে দিয়েছে। এই দুই গোষ্ঠীর সঙ্গেই অতীতে আইসিস এবং আল-কায়দার যোগাযোগ ছিল। এদের নেতার নামই আবু মহম্মদ আল গোলানি। আমেরিকা একসময়ে এঁর মাথার দাম ধার্য করেছিল ভারতীয় মুদ্রায় ৭৫ কোটি টাকা। আইসিস নেতা আবু বকর আল বাগদাদি মারা যাওয়ার পর সিরিয়ার ইদলিব সংলগ্ন এলাকায় প্যারালাল গভর্মেন্ট চালানো শুরু করে দেন তিনি। আসাদ-বিরোধী এমন একজন শক্তিশালী নেতাকে তলায় তলায় মদত দেয় আমেরিকা।
আসাদ সপরিবারে রাশিয়া পালিয়ে যাওয়ার পরে সরকারি প্রশাসনে অবশিষ্ট বলতে এখন শুধু আছেন সিরিয়ার প্রধানমন্ত্রী মহম্মদ গাজি জালালি। তিনি বলেছেন যে বিদ্রোহীদের হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে তিনি প্রস্তুত। গোলানিই কি তাহলে সিরিয়ার পরবর্তী শাসক? নাকি বিদ্রোহীরা সমস্ত পক্ষের সঙ্গে কথা বলে একটা অন্তর্বর্তী সরকার তৈরি করবেন? তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে, গোলানিই যে পরে একদিন আমেরিকা-সহ পশ্চিমী দুনিয়ার মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠবেন না, তা কিন্তু এখনই জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। আমেরিকা তো কম ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন তৈরি করেনি। সিরিয়ার সংখ্যালঘু খ্রিস্টানরা এখনই সংবাদমাধ্যমকে বলতে শুরু করে দিয়েছেন যে তাঁরা প্রাণের ভয় পাচ্ছেন। লেবানন ও জর্ডনে পালিয়ে যাওয়া যায় কি না তা ভাবতে হচ্ছে।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours