শোভন চক্রবর্তী

দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বারুইপুর পুরসভার ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে সিপিএম প্রার্থী করেছে ভোম্বল মিস্ত্রিকে। তিনি পেশায় রাজমিস্ত্রি। বামফ্রন্ট মনোনীত সিপিএম প্রার্থী হিসেবে নদিয়ার নবদ্বীপ পুরসভার ২২ নম্বর ওয়ার্ডে লড়ছেন গৌরহরি দাস। কী করেন?

তিনি মাছ বিক্রেতা। বর্ধমান পুরসভার ১৬ নম্বর ওয়ার্ড তফসিলি সংরক্ষিত। এই ওয়ার্ডে লালঝান্ডার প্রার্থীর মানু খাঁ টোটো চালান। বর্ধমানের পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডে বামেদের প্রার্থী মনিরুল ইসলাম এতজন ঠিকা শ্রমিক। ২৭ ফেব্রুয়ারি যে ১০৮টি পুরসভার ভোট তারমধ্যে প্রায় ৯০টির মতো পুরসভায় কোথাও সব আসনে আবার কোথাও অধিকাংশ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করে দিয়েছে বামফ্রন্ট। যেগুলি বাকি রয়েছে সেগুলিও শনি-রবিবারের মধ্যে হয়ে যাবে। কিন্তু উত্তরবঙ্গ থেকে দক্ষিণবঙ্গ—বামেদের প্রার্থী তালিকায় চোখ রাখলে দেখা যাবে শয়ে শয়ে এমন প্রার্থী করেছে তারা যাঁরা আর্থিক ভাবে প্রান্তিক অংশের। এখানে বলে রাখা ভাল, সিপিএমের দলীয় রীতি অনুযায়ী পুরসভা ও পঞ্চায়েত ভোটের ক্ষেত্রে জেলা কমিটিই প্রার্থী তালিকায় অনুমোদন দেয়। তবে সেটা অফিশিয়াল সিলমোহরটুকুই। মূলত স্থানীয় স্তরেই ঠিক হয় প্রার্থী।
তাতে দেখা যাচ্ছে, বর্ধমান থেকে বারুইপুর, বজবজ থেকে বাঁশবেড়িয়া, দমদম থেকে দিনহাটা—সর্বত্রই একই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে বামেরা। যে তালিকায় বাড়তি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে গরিব অংশের মানুষকে। বামেদের অভিধান অনুযায়ী 'মেহনতী'দের। হঠাত্‍ কেন এমন সিদ্ধান্ত?
সিপিএমের মধ্যেই আলোচনা চলছিল, গরিবমানুষের থেকে দলের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া নিয়ে। সম্প্রতি দলের এরিয়া ও জেলা সম্মেলনগুলিতে ব্যাপক ভাবে এই আলোচনা হয়েছে। অনেকে এও বলেছেন, পার্টি দুর্বলতাকে চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। একাধিক জেলা সম্মেলনে প্রতিনিধিরা বলেছেন, আসল দুর্বলতা হল শ্রেণি বিচ্ছিন্নতা। তাকে ঢাকতে জোটের শর্টকাট রাজনীতির কৌশল নেওয়া হয়েছে। দেখা গেল জেলা সম্মেলন পর্ব যখন শেষের মুখে তখনই জেলায় জেলায় প্রান্তিক অংশের মানুষজনকে কাস্তে হাতুড়ি তারা চিহ্নে দাঁড় করাল সিপিএম।
এখন প্রশ্ন হল, এই ব্যামো কি সিপিএমের নতুন?
অনেকের মতে, একেবারেই তা নয়। বরং বলা যেতে পারে, এই শ্রেণি বিচ্ছিন্নতার ক্যানসার সিপিএমের শরীরে বাসা বেঁধেছিল ৩৪ বছরের শাসনের মাঝামাঝি সময় থেকেই। পঞ্চায়েতের কাজকর্ম বোঝার মতো লোক চাই বলে যুক্তি তুলে ধরে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া, স্কুল শিক্ষকের স্ত্রী, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক প্রমুখকে প্রার্থী করাকেই রেওয়াজ করে নিয়েছিল সিপিএম। নানা সুবিধা আদায়ের লক্ষ্যে এই অংশের মানুষ আবার বিরোধী শিবিরে ভিড়তেন না তেমন। আবার, সেই সময়ে তৃণমূলের প্রার্থী তালিকায় বেশিরভাগেরাই ছিল দরিদ্র অংশের। এইভাবে প্রান্তিক অংশের সঙ্গে সিপিএমের দূরত্ব তৈরি হতে থাকে। সেই প্রবণতা বড় ভাবে ধরা পড়েছিল ২০০৮-এর পঞ্চায়েত ভোটে। সেবার গ্রাম পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতির অর্ধেক চলে যায় বিরোধীদের দখলে, যার সিংহভাগই ছিল তৃণমূলের হাতে।
তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর নানা সুবিধা পেয়ে সেই মানুষের সিংহভাগই যে এখন বর্তমান শাসক দলের সঙ্গে ভোটের ফলেই তা প্রমাণ মিলছে। ঘুরে দাঁড়াতে হলে ওই মানুষদের ঘরে ফেরাতে হবে, এই বুঝেই প্রার্থী তালিকায় শ্রেণি যোগাযোগ মজবুত করার বার্তা দিল সিপিএম। যখন সেই তৃণমূলের পঞ্চায়েত নেতারাই এখন কোটি কোটি টাকার মালিক।
এবারের পুর ভোটে বহু তরুণ মুখকেও প্রার্থী করেছে বামেরা। পাড়ায় পাড়ায় রেড ভলান্টিয়ার হিসেবে যাঁরা কাজ করেছিলেন তাঁদের ঢালাও টিকিট দেওয়া হয়েছে জেলায় জেলায়। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের কথায়, মানুষই পার্থক্য করতে পারবেন। একদিকে তৃণমূলের করে খাওয়া নেতারা, অন্যদিকে আমাদের প্রার্থীরা। কাদের কাউন্সিলরগিরি করে কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি হয়েছে আর কারা মানুষের জন্য কাজ করেন জীবন বাজি রেখে মানুষ তাঁদের অভিজ্ঞতায় দেখছেন।

Share To:

kakdwip.com

Post A Comment:

0 comments so far,add yours