দীর্ঘ প্রায় তিন বছর আগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিলেন বৃদ্ধা সূর্য্যমনি সরদার। পথ ভুলে আর বাড়িতে ফেরা হয়ে ওঠেনি। ঠিকানাও বলতে পারেননি কাউকে।শারদীয়ার শেষে মা দুর্গা যখন কৈলাশে ফিরলেন,ঠিক সেই মুহূর্তে ধরনীতে আলো করে এলেন লক্ষ্মীদেবী।তেমন সুন্দর মুহূর্তে প্রত্যন্ত সুন্দরবনের এক সহৃদয় যুবকের উদ্যোগে হাসি মনে পরিবারের লোকজনদের কাছে ফিরে গেলেন ৮৫ বছরের বৃদ্ধা সুর্য্যমনিতবে সেই হাসি ছিল সাময়িক। তারপর থেকেই শোকে মর্মাহত হয়ে পড়েন ওই বৃদ্ধা।
ঘটনার শুরু হয়েছিল বিগত তিন বছর আগে।উত্তর ২৪ পরগনা জেলার হাসনাবাদ থানার অন্তর্গত রুপমারী বেড়ের চক এলাকার বাসিন্দা সূর্য্যমনি সরদার। বিগত ১০ বছর আগেই স্বামী বিষম সরদার মারা যায়।তার আগে অবশ্য তিন কন্যা কে বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলেন।দরিদ্র সুর্যমনি সরদার তাঁর একমাত্র সন্তান খোকন কে নিয়ে কষ্ঠেশিষ্টে দিন কাটাচ্ছিলেন।তিন নাতনি কে নিয়ে আনন্দে ছিলেন বৃদ্ধা।ছেলের সামান্যতম আয়ে কোন প্রকারে চলছিল সংসার।বিগত তিন বছর আগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পথ ভুলে আর বাড়িতে ফেরা হয়ে ওঠেনি। এখানে সেখানে রাস্তাঘাটে দিন কাটিয়ে গত প্রায় ছয়মাস আগে ঠাঁই হয়েছিলে প্রত্যন্ত সুন্দরবনের ঝড়খালি এলাকার পার্বতিপুর গ্রামে। অন্যদিকে পরিবারের একমাত্র সন্তান খোকন সরদার মা কে বিস্তর খোঁজাখুঁজির না পেয়ে পরে হাল ছেড়ে দেয়।পরে এক বন্ধুর কাছে জানতে পারে তার মা মারা গিয়েছে। সেই কথা শুনে শাস্ত্রমতে গলায় কাছা নিয়ে শ্রাদ্ধশান্তি করার জন্য যত্‍সামান্য আয়োজনের তোড়জোড় করেছিল। একসময় নিজের মায়ের মৃত্যু হয়েছে মেনে নিতে দ্বিধাবোধ করে গলার কাছা ছিঁড়ে ফেলে। শ্রাদ্ধশান্তিও বন্ধ করে দেয়। আবারও মায়ের খোঁজ শুরু করে। যদি মা কে ফিরে পাওয়া যায়!
অবশেষে হারিয়ে যাওয়া গর্ভধারিণী মা কে খুঁজে না পেয়ে শোকে ভেঙে পড়ে। পরে ইয়াস সাইক্লোনের ১৫ দিন আগে মায়ের শোকে মৃত্যু হয় খোকনের।
অন্যদিকে গত ছয় মাস আগে ঝড়খালির পার্বতিপুরে ঠাঁই নেওয়া বৃদ্ধা এলাকার সকলের কাছে ঠাকুমা হিসাবে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন।বৃদ্ধা সূর্য্যমনি যখন যাকে কাছে পেতেন তখনই তাকে বলতেন 'আমাকে বাড়িতে দিয়ে আসবি চল না বাবা!আমি কি বাড়িতে ফিরতে পারবো না?!'
এলাকার যুবক প্রশান্ত সরকার এমন কথা বৃদ্ধার কাছ থেকে জেনে তাঁর সঠিক ঠিকানা জানার চেষ্টা করতে থাকেন।দীর্ঘদিন অতিবাহিত হলেও মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে বৃদ্ধা সঠিক ঠিকানা বলতে পারছিলেন না। অন্যদিকে হাল ছাড়ার পাত্র নন এলাকার সহৃদয় যুবক প্রশান্ত সরকার।অবশেষে নিরুপায় হয়ে বৃদ্ধার সঠিক ঠিকানা পেতে তার একটি ছবি সোশ্যাল মিডিয়া পোষ্ট করেন তিনি।
কয়েক দিনের মধ্যেই হাসনাবাদের প্রসেনজিত্‍ প্রামাণিক নামে এক যুবক প্রশান্ত সরকারের সাঠে বৃদ্ধার সঠিক পরিচয় ঠিকানা জানিয়ে যোগাযোগ করেন। হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন সুন্দরবনের যুবক।
প্রত্যন্ত সুন্দরবনের পার্বতিপুর গ্রামে হাজীর হয় বৃদ্ধার ভাইপো চিনিবাস সরদার ও প্রতিবেশি বনমালি সরদার। বৃদ্ধা পরিবারের সদস্যদের দেখে চিনতে পারেন। বাড়িতে ফিরে যাওয়ার আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠেন। গ্রামবাসীরা তাদের আদরের ঠাকুমা কে বিদায় জানিয়ে পরিবারের হাতে তুলে দেয়। অন্যদিকে নেপথ্য নায়ক প্রশান্ত সরকার ঠাকুমার জন্য তিন তিনটি নতুন শাড়ি,একমাসের খাদ্যসামগ্রী এবং রান্নার সমস্ত সরঞ্জাম পরিরারে সদস্যদের হাতে তুলেদেয়। দীর্ঘ তিন বছর পর বাড়িতে ফিরে যাওয়ার আনন্দে ৮৫ বছরের বৃদ্ধা জোর কদমে পা চালিয়ে সঙ্গীদের সাথে রওনা দেয়।যা এক যুবক কে ও হার মানাবে।
চোখের জল ফেলতে ফেলতে সুন্দরবনের যুবক প্রশান্ত সরকার বলেন 'বৃদ্ধা আমাদের এখানে প্রায় ছমাস আশ্রয় নিয়েছিলেন। সকলের কাছে ঠাকুমা হিসাবে পরিচিত হয়েছিলেন।তাঁকে আজ তাঁর পরিবারে হাতে তুলে দিতে পেরে যা আনন্দ হওয়ার কথা,তার থেকে দুঃখ হচ্ছে অনেক বেশি।কারণ আমরা সকলে এক নিকট আত্মীয় ঠাকুমা কে বিদায় জানানোর জন্য। তবে ঠাকুমা কেমন থাকেন সে বিষয়ে ভবিষ্যতে তাঁর পরিবারের সাথে যোগাযোগ রাখবো'।
অন্যদিকে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে শুক্রবার সন্ধ্যায় যখন নিজের বাড়িতে পা রাখলেন সূর্য্যমনি,প্রতিবেশিরা তাঁকে দেখার জন্য ভীড় জমাতে থাকেন। বৃদ্ধা একে একে সকল কে দেখতে পেলেও নিজের সন্তান কে দেখতে না পেয়ে শোকে ভেঙে পড়েন।
হারিয়ে যাওয়া মা সূর্য্যমনি আলো করে বাড়িতে ফিরলেও নিজের পরিবারে নেমে এসেছে এক নিস্তঃব্ধতা।অপলক দৃষ্টিতে চাতকের মতো নিজের গর্ভের সন্তান খোকনের পথ চেয়ে তাকিয়ে বৃদ্ধা সূর্য্যমনি।বৃদ্ধার জীবনে একটি যুগের অবসান হলেও নতুন যুগের সূচনা হল বৃদ্ধার পরিবারে।
Share To:

kakdwip.com

Post A Comment:

0 comments so far,add yours