এলোমেলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে, বাঁশ-রঙিন কাপড়ের টুকরো-সুতলি দড়ি। ভাঙা মণ্ডপের সামনেই চুপ করে আছে মালা-ঢাকা লম্বাটে কফিনটা। তাকে ঘিরে ভিড় ভেঙেছে কালীঘাটের সরু রাস্তায়। সেই ভিড় থেকে খানিক তফাতে, পাড়ার রোয়াকে বসে ছেলেটি এক টানা ফুঁপিয়ে চলেছে— 'যাওয়ার মুখে মোবাইলটা না হয় হারালি, তার পর পুজোর বিকেলে তুই-ও হারিয়ে গেলি, এটা ঠিক করলি বল দিব্য (শুভায়ন দাসের ডাক নাম)!'পাহাড়ের ডাকে সাড়া দিয়ে ষষ্ঠীর বিকেলে শহর ছাড়ার আগেই হাওড়া স্টেশন থেকে হারিয়ে গিয়েছিল শুভায়নের মোবাইল ফোনটা। পাড়ার বন্ধু রাজদীপ বলছেন, ''ট্রেনে উঠে সঙ্গীদের থেকে ফোন নিয়ে মাকে জানিয়েছিল, 'চিন্তা কোরো না তো, ফোনটা হারিয়েছি, তবে আমি তো আছি!'' তার পর ঠোঁট কামড়ে চোখ মুছছেন, ''তুই আর কোথায় থাকলি বল!'' কালীঘাটের নেপাল ভট্টাচার্য স্ট্রিটে শুভায়নদের বাড়িটা থেকে তখন শুধুই গুমরে ওঠা কান্নার রোল।

উত্তরাখণ্ডের লামখাগা পাসে ট্রেক করতে গিয়ে তুষার ঝড়ে প্রাণ-হারা শুভায়নের মতোই বুধবার কফিনবন্দি হয়ে ফিরেছে আরও চারটি দেহ। এ দিন সকালে দিল্লি থেকে দু'দফায় বিমানে আসে একে একে পাঁচটি কফিন। প্রথম দফায় এসে পৌঁছয় বিকাশ মাকাল, রিচার্ড মণ্ডল এবং সৌরভ ঘোষের মরদেহ। খানিক পরেই দ্বিতীয় বিমানে আসে কবরডাঙার পাত্রপাড়ার তনুময় তিওয়ারি এবং শুভায়নের দাসের দেহ। সকাল থেকেই বিমানবন্দরের কার্গো কমপ্লেক্সে ভিড় করেছিলেন মৃতের স্বজন-বন্ধুরা। বিমান রানওয়ে ছুঁতেই রিচার্ডের এক বন্ধু নিজের মনেই যেন প্রশ্ন করলেন, ''কী হল বলুন তো, এতগুলো তরতাজা ছেলে এ ভাবে কফিনবন্দি হয়ে ফিরল!'' হা-হুতাশ, কান্নার মাঝেই দেহগুলি পরিজনের হাতে দ্রুত তুলে দেন কার্গো বিভাগের কর্মীরা। পাঁচটি কফিন দু'দফায় পৌঁছনোর পরেই নিয়ম-পর্ব চুকিয়ে তা শববাহী গাড়িতে তুলে বাড়ির দিকে রওনা করিয়ে দেয় পুলিশ।

বেলা সোয়া বারোটা নাগাদ কালীঘাটে শুভায়নের দেহ পৌঁছতেই গোটা পাড়া কান্নায় ডুকরে ওঠে। শুভায়নের পুরনো বন্ধু তড়িত্‍ মুখোপাধ্যায় বলেন, ''এমন হাসিমুখের ছেলে দেখা যায় না। যে কারও বিপদে প্রথম হাজির হত দিব্য। এমন পরোপকারী, মিশুকে ছেলেকে এমন কফিন ঢাকা অবস্থায় দেখতে হবে, ভাবিনি।'' শুভায়নের দাদা শুভজিত্‍ বলেন, ''ওরা এগারো জন রওনা দিয়েছিল উত্তরাখণ্ডে। জানিয়েছিল, লামখাগা পাস ধরে ট্রেক করে ছিটকুল-দেবীকুন্ড হয়ে ফিরবে। নবমীর রাতে ভাইয়ের সঙ্গে শেষ কথা হল, তার পর...!'' স্থানীয় সাংসদ তৃণমূলের মালা রায় এবং বিধায়ক দেবাশিস কুমারও হাজির ছিলেন কফিনের পাশে। দেবাশিস জানান, পেশায় মেডিক্যাল রিপ্রেজ়েন্টেটিভ শুভায়ন শুধু পাড়ায় নন, আশপাশের এলাকাতেও ছিলেন পরিচিত মুখ।

কবরডাঙার তনুময় তিওয়ারিও পাড়ি দিয়েছিলেন লামাখাগার পথে। তাঁর বন্ধুরা জানাচ্ছেন, ১৪ অক্টোবর, নবমীর বিকেলেই লামখাগা পাস হয়ে ছিটকুলের দিকে যাওয়ার পথে দেবীকুন্ডের কাছে হারিয়ে গিয়েছিলেন তনুময়। দিন কয়েক পরে সেখান থেকে তাঁর দেহ উদ্ধার করে আইটিবিপি'র জওয়ানেরা। বাড়িতে জানিয়েছিলেন, ৫ নভেম্বর জন্মদিনটা বড় করেই পালন করবেন এ বার। পাত্র পাড়ার বাড়িতে এ দিন কফিন পৌঁছতেই তনুময়ের বাবা অমিত বলছেন, ''তোর মা এ বার এত বার করে বারণ করল, শুনলি না তো!'' তার পর নিজের মনেই বলছেন, ''সারা বছর খাটাখাটনির পর বাইরে যেতে চেয়েছিল। কী করে আর বারণ করি, তখনও কি জানতাম পরিবারের এক মাত্র ছেলেটা কফিনবন্দি হয়ে ফিরবে!'' তনুময়ের সঙ্গেই গিয়েছিলেন তাঁর মামা সুখেন মাঝি। খোঁজ মেলেনি তাঁর। কবরডাঙা এখন তাঁর অপেক্ষায়!

দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিষ্ণুপুরের নেপালগঞ্জের অপেক্ষা ভাঙে বেলা বারোটা নাগাদ। তিনটি শববাহী গাড়িতে একে একে পৌঁছয় বিকাশ মাকাল, সৌরভ ঘোষ এবং রিচার্ড মন্ডলের কফিনবন্দি দেহগুলি। ভিড় ঠেলে রাঘবপুর সেন্ট জোসেফ গির্জায় পরপর সাজিয়ে রাখা হয় কফিন। মৃতদেহ। স্বজনেরা জানান, বিকাশ ও সৌরভের বাড়ি রাঘবপুর চার্চের কাছেই। রিচার্ডের বাড়ি বারুইপুরের কল্যাণপুরে। তবে রাঘবপুরে মামার বাড়িতে থেকেই পড়াশোনা চালাচ্ছিলেন রিচার্ড। বিকাশের এক আত্মীয় বলেন, ''ওরা সেন্টপলস্ স্কুলের ছাত্র। এক সঙ্গেই বড় হয়েছে। ট্রেকিংয়েও যেত এক সঙ্গে। শুধু সেই রাতে ঝড়ের সময়ে তিন জনে ছিটকে গিয়েছিল পরস্পরের কাছ থেকে।'' রিচার্ডের এক পড়শি বলছেন, ''হাত-ছেড়ে যাওয়া তিন বন্ধু, কফিন বন্দি হয়ে ফের এক সঙ্গেই ফিরে এল গ্রামে, এও দেখতে হল!''
Share To:

kakdwip.com

Post A Comment:

0 comments so far,add yours