প্রতি বছরই নভেম্বর-ডিসেম্বরে দিল্লির বাতাসের মান নেমে যায় ভয়াবহ স্তরে। PM 2.5 ও PM 10-এই দুই দূষণ কণার মাত্রা বেড়ে যায় ভয়ঙ্করভাবে। এতটাই দূষণ বাড়ে যে শ্বাস নেওয়া পর্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। প্রতিবেশী রাজ্যগুলিতে ধান কাটার পর খড় পোড়ানো, গাড়ির ধোঁয়া, নির্মাণকাজের জন্য ধূলিকণা ও শিল্পাঞ্চলের ধোঁয়া নির্গমন থেকে এই দূষণ হয়



রাস্তায় বের হলেই চোখ-নাক জ্বালা, গলা ধরে আসছে। দিল্লিতে দীপাবলি মানেই আতঙ্ক। বাকি দেশে আলোয় যখন ঝলমল করে, তখন দূষণ-বিষাক্ত ধোঁয়ার চাদর মুড়ে নেয় দিল্লি ও সংলগ্ন এলাকাগুলিকে। এটা প্রতি বছরেরই চেনা ছবি। আতশবাজিতে নিষেধাজ্ঞা, বড় ট্রাক চলাচল বন্ধ করা, ছোট গাড়িতে জোড়-বিজোড় নিয়ম, রাস্তায় নিয়মিত জল দেওয়া- এই ধরনের হাজারো পন্থা গ্রহণ করা হয়েছে রাজধানীতে, কিন্তু দূষণ থেকে মুক্তি মেলেনি। এবার দিল্লিতে দূষণ কমাতে শেষ আশা, কৃত্রিম বৃষ্টি (Artificial Rain)। প্রযুক্তি এত এগিয়ে গিয়েছে যে কৃত্রিমভাবে বৃষ্টিও নামানো সম্ভব। কীভাবে এই বৃষ্টি হবে?


পরিবেশ যদি অনুকূল থাকে, তাহলে আগামী বৃহস্পতিবার, ২৯ অক্টোবর দিল্লিতে নামানো হতে পারে কৃত্রিম বৃষ্টি। এর জন্য প্রয়োজন আকাশে মেঘের। মৌসম ভবন জানিয়েছে, ২৮, ২৯ ও ৩০ অক্টোবর দিল্লির আকাশে মেঘ থাকবে। সেই তথ্যের উপরে ভরসা করেই কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর পরিকল্পনা করেছে দিল্লি সরকার। আইআইটি কানপুর (IIT Kanpur)-কে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ক্লাউড সিডিং (Cloud Seeding) করে বৃষ্টি নামানোর। যদি সত্যি বৃষ্টি নামে, তাহলে দিল্লিতে এই প্রথমবার ক্লাউড সিডিং পদ্ধতিতে কৃত্রিম বৃষ্টি করানো হতে পারে দূষণ রুখতে।




দিল্লির পরিবেশমন্ত্রী মনজিন্দর সিং সিরসা জানিয়েছেন, ৩.২১ কোটি টাকার এই উদ্যোগে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কৃত্রিম বৃষ্টি করানো হবে। কানপুর আইআইটি থেকে পাঠানো একটি বিশেষ বিমান উড়বে উত্তর-পশ্চিম দিল্লি ও দিল্লির পার্শ্ববর্তী এলাকার উপর দিয়ে। এর জেরে মেঘে জলীয় বাষ্প সম্পৃক্ত হবে এবং বৃষ্টির সৃষ্টি করবে।

প্রসঙ্গত, গত মাসেই দিল্লি সরকার আইআইটি কানপুরের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে ক্লাউড সিডিং নিয়ে। ৫টি ক্লাউড সিডিং ট্রায়াল করা হবে। শোনা যাচ্ছে, ২৯ অক্টোবর উত্তর-পশ্চিম দিল্লিতে ক্লাউড সিডিংয়ের মাধ্যমে বৃষ্টি করা হতে পারে। এবার প্রশ্ন হল, কৃত্রিম বৃষ্টি হয় কীভাবে।

কৃত্রিম বৃষ্টি কীভাবে তৈরি হয়?
কৃত্রিম বৃষ্টি হল একটি বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে মেঘে রাসায়নিক পদার্থ ছড়িয়ে বৃষ্টিপাত ঘটানো হয়। সাধারণত সিলভার আয়োডাইড (Silver Iodide), সোডিয়াম ক্লোরাইড (লবণ) বা পটাশিয়াম আয়োডাইড ব্যবহার করা হয় এই প্রক্রিয়ায়। জলীয় বাষ্প পূর্ণ মেঘের উপরে সিলভার আয়োডিনের ন্যানোপার্টিকেল, আয়োডাইজ়ড নুন ও রক সল্টের মিশ্রণ ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এরপরে মেঘ সম্পৃক্ত হয়ে বৃষ্টি নামে।

ক্লাউড সিডিং অর্থাৎ মেঘে সেচন, এর অর্থ হল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পার্টিকেল বায়ুমণ্ডলে মেশানো হয়, যা জলীয় বাষ্পের সঙ্গে মিশে জলকণা বা বরফ ক্রিস্টালে পরিণত হয়। এর জেরেই বৃষ্টি হয়।

কীভাবে নামে বৃষ্টি?
প্রথমে আবহাওয়াবিদরা এমন মেঘ শনাক্ত করেন, যেখানে পর্যাপ্ত জলীয় বাষ্প আছে।
বিমানের সাহায্যে বা রকেটের মাধ্যমে ওই মেঘে সিলভার আয়োডাইড ঢালা হয়।
এই রাসায়নিক পদার্থ মেঘের ভেতরের ক্ষুদ্র জলকণাগুলিকে একত্রিত হতে সাহায্য করে।
ফলে কণাগুলি বড় হয়ে যায় ও শেষমেশ বৃষ্টির ফোঁটায় পরিণত হয়।
এই প্রক্রিয়াটিকেই বলা হয় Cloud Seeding বা মেঘ বপন প্রযুক্তি।
দিল্লিতে কেন কৃত্রিম বৃষ্টির প্রয়োজন পড়ল?
প্রতি বছরই নভেম্বর-ডিসেম্বরে দিল্লির বাতাসের মান নেমে যায় ভয়াবহ স্তরে। PM 2.5 ও PM 10-এই দুই দূষণ কণার মাত্রা বেড়ে যায় ভয়ঙ্করভাবে। এতটাই দূষণ বাড়ে যে শ্বাস নেওয়া পর্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। প্রতিবেশী রাজ্যগুলিতে ধান কাটার পর খড় পোড়ানো, গাড়ির ধোঁয়া, নির্মাণকাজের জন্য ধূলিকণা ও শিল্পাঞ্চলের ধোঁয়া নির্গমন থেকে এই দূষণ হয়। প্রাকৃতিকভাবে বৃষ্টি না হলে, এই ধোঁয়া ও ধুলো বাতাসে ভাসমান অবস্থায় থাকে। যাতে বিপদ আরও বাড়ে। এই দূষণ কমাতেই পরিবেশ বিজ্ঞানীরা কৃত্রিম বৃষ্টির পরামর্শ দিয়েছেন। বৃষ্টির মাধ্যমে এই দূষণ কণাগুলি ধুয়ে ফেলা সম্ভব, মাটিতে ধুলো মিশে যাওয়ায়, বাতাসের গুণমান কিছুটা হলেও উন্নত হবে।

প্রসঙ্গত, এর আগে বিশ্বের একাধিক দেশে কৃত্রিম বৃষ্টি করানো হয়েছে। চিন, আমেরিকায় সফলভাবে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানো হয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরশাহিতেও গ্রীষ্মকালে কৃত্রিম বৃষ্টি করানো হয়েছে। দুবাইয়ে খরার সময় নিয়মিতভাবে কৃত্রিম বৃষ্টির মাধ্যমে বাতাসে শুষ্কতা কমানো হয়। আবার চিনে অলিম্পিকের সময় আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণে রাখতে ক্লাউড সিডিং করা হয়েছিল।

ভারতেও মহারাষ্ট্র, কর্নাটক ও তামিলনাড়ুতে পরীক্ষামূলকভাবে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়েছে খরা কমানোর জন্য। দিল্লিতে এর আগে কেজরীবাল সরকারও বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রচেষ্টা করেছিল।

কৃত্রিম বৃষ্টির খরচ-
যদি ছোট আকারে কৃত্রিম বৃষ্টি করাতে হয়, তাতে খরচ পড়ে ১২.৫ লাখ টাকা থেকে ৪১ লক্ষ টাকা। বড় মাপে যদি বৃষ্টি নামানোর পরিকল্পনা থাকে, তাহলে ৮ কোটি থেকে ১২ কোটি টাকা খরচ হতে পারে প্রতি বছর। প্রাথমিকভাবে এর খরচ অনেক বেশি হলেও, এর থেকে যে আর্থিক লাভ হয়, তাতে খরচ পুষিয়ে যায়। আমেরিকায় ক্লাউড সিডিং করে কৃত্রিম বৃষ্টিতে ২০ থেকে ৪০ মিলিয়ন ডলারের লাভ হয়।

দিল্লিতে ৫টি ক্লাউড সিডিংয়ের জন্য ৩.২১ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে বিজেপি সরকার। প্রতিটি ট্রায়ালের জন্য ৫৫ লাখ টাকা থেকে ১.৫ কোটি টাকা খরচ হতে পারে। এছাড়া প্রাথমিক পরিকাঠামোর জন্য আরও ৬৬ লাখ টাকা খরচ হবে। ১০০ স্কোয়ার কিলোমিটার এলাকায় বৃষ্টি হলে, ৫-৬ দিনের জন্য স্বস্তি মিলবে। এর জন্য প্রতি স্কোয়ার কিলোমিটারে গড়ে ১ লক্ষ টাকা খরচ হতে পারে।

চ্যালেঞ্জ ও সীমাবদ্ধতা-
তবে কৃত্রিম বৃষ্টি সব সময় কার্যকর হয় না। এর সাফল্য অনেকটাই নির্ভর করে—

মেঘের প্রকার ও আর্দ্রতার মাত্রার উপর
বাতাসের তাপমাত্রা ও বায়ুচাপের উপর
এবং বৃষ্টির প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত রাসায়নিকের পরিমাণের উপর
এছাড়া, কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর গোটা প্রক্রিয়া অনেকটা ব্যয়বহুল। এবং রাসায়নিক ব্যবহারে পরিবেশগত প্রভাব নিয়েও যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। দিল্লির মতো বড় মেট্রো শহরে জন্য কৃত্রিম বৃষ্টি আপাতত এক জরুরি পরীক্ষামূলক উপায়। এটি দূষণ কমাতে স্বল্পমেয়াদে সহায়ক হতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে দূষণ কমাতে ন্যাড়াপোড়া বন্ধ করা, যানবাহন নিয়ন্ত্রণ ও শিল্পের নির্গমন কমানোর মতো পদক্ষেপ করতে হবে।
Share To:

kakdwip.com

Post A Comment:

0 comments so far,add yours