আমার থিয়েটারে হিরো পিছনে কালো পর্দার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে ওই দেখো চাঁদ। পর্দার কোনও পরিবর্তন হয় না। চাঁদ ফুটে ওঠে না। অথচ সামনে বসে থাকা সকল দর্শক বিশ্বাস করে ওখানে চাঁদ উঠেছে। আসলে এই চাঁদ তাঁদের সকলের মনের ভিতরে থাকা চাঁদ: রতন থিয়াম
“আপনি কেবল থিয়েটার করেন কেন? সিনেমায় অভিনয় করেন না কেন?”, হাসতে হাসতে দাড়িওয়ালা লোকটার দিকে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলেন সাংবাদিক। সেদিন দাড়িওয়ালা লোকটার কথা শুনে থমকে গিয়েছিল সকলে। এইভাবেও কেউ ভাবতে পারে!
তিনি বলেছিলেন, “তোমাদের সিনেমায় হিরো আঙুল দেখিয়ে বলে ওই দেখো চাঁদ। ক্যামেরা প্যান হয়, পর্দার উপর ফুটে ওঠে একটি সুন্দর চাঁদ। সকলে সেই চাঁদ দেখতে পায়। আর আমার থিয়েটারে হিরো পিছনে কালো পর্দার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে ওই দেখো চাঁদ। পর্দার কোনও পরিবর্তন হয় না। চাঁদ ফুটে ওঠে না। অথচ সামনে বসে থাকা সকল দর্শক বিশ্বাস করে ওখানে চাঁদ উঠেছে। আসলে এই চাঁদ তাঁদের সকলের মনের ভিতরে থাকা চাঁদ। আমি মানুষকে তাঁদের মনের ভিতরে লুকিয়ে থাকা চাঁদটা দেখানোর জন্য নাটক করি।” সেদিনের সেই দাড়িওয়ালা লোকটা হলেন রতন থিয়াম।
বর্ষাকালে গলা খুশখুশ? ডাক্তারের কাছে ছোটার আগে কাজে লাগান 'হেঁশেলের হিরো'কে!
ভারত স্বাধীন হওয়ার এক বছর পরে ১৯৪৮ সালে এই পশ্চিমবঙ্গের নবদ্বীপে জন্ম হয় রতনের। তবে তাঁর বেড়ে ওঠা কাজ সবটাই মণিপুরে। রতন আর পাঁচটা নাট্য নির্দেশকদের মতো নয়। চেনা নাটককে অচেনা মোড়কে পরিবেশন করাই ছিল রতনের বৈশিষ্ট্য। শুধু তো থিয়েটার করা নয়। বদলে ফেলেছিলেন মণিপুরী থিয়েটারের ধাঁচাটাই।
ভারতীয় থিয়েটার তথা ভারতীয় সংস্কৃতিকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এনে দেওয়ার নেপথ্যেও কিন্তু এই রতনই। শুনলে অবাক হবেন রতনের যে নাট্য দলের একের পর এক নাট্য প্রযোজনা মণিপুর থেকে রাজ্যের গণ্ডি পার করে ছড়িয়ে পড়েছে দেশ ছাড়িয়ে হয়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক বিস্ময়ের কারণ, চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছে তথাকথিত পাশ্চাত্যের প্রভুদের চোখ, সেই দলের বেশির ভাগের কেউই অভিনেতাই নন। বরং তিনি দল তৈরি করলেন মণিপুরের মার্শাল আর্টে পারদর্শীদের নিয়ে। তাঁদের প্রশিক্ষণ দিলেন নিজস্ব পদ্ধতিতে।
কী অদ্ভুত! একেবারে শিকড় থেকে ছেলেমেয়েদের ধরে এনে নিজের হাতে গড়েপিঠে বানালেন এক একজন তুখর অভিনেতা। কাজটা মোটেও সহজ ছিল না। দলের প্রত্যেককে যেতে হয়েছিল কঠিন অধ্যাবসায় এবং অনুশীলন পদ্ধতির মধ্য দিয়ে। তাছাড়া থিয়েটার তো এটাই শেখায় মানুষকে।
পড়াশোনা করার সময় ঠিক করেছিলেন থিয়েটার হবে তাঁর জীবন। যেমন ভাবা তেমন কাজ। ১৯৭৪ সালে দিল্লির ন্যাশানাল স্কুল অব ড্রামা (NSD) থেকে হলেন গ্রাজুয়েট। থিয়েটার বা অভিনয়ের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত তাঁদের কাছে NSD মক্কার মতো পবিত্র। এমনকি অনেকেই জানেন, নাসিরুদ্দিন শাহ, ওম পুরী, নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি থেকে পঙ্কজ ত্রিপাঠী, ভারতের চলচ্চিত্র জগতের বহু অভিনেতাই অভিনয়ের পাঠ নিয়েছেন এখানে।
সত্তরের দশকে মাঝামাঝি ১৯৭৬ সালে মণিপুরে গিয়ে গড়লেন নিজের দল কোরাস রেপোর্টারি। সে সময়ে অল্প পরিচিত বেড়েছে রতনের। ভারতীয় থিয়েটারে তখন চলছে এক স্বর্ণযুগ। মারাঠি থিয়েটারে বদল আনছেন বিজয় তেন্ডুলকর। দক্ষিণ ভারতে আলোড়ন তৈরি করছে গিরিশ কারনাডের একের পর এক মহাকাব্য এবং পুরাণ ভিত্তিক নাটক। বাংলার রঙ্গমঞ্চে এক বিপ্লবের সূচনা করতে চলেছেন বাদল সরকার। প্রথাগত মঞ্চ থিয়েটার ভেঙে বেরিয়ে তৈরি করছেন ‘থার্ড ফর্ম অব থিয়েটার’। এমন সময়ে মণিপুরেও আরেক বিপ্লবের শুরু করছেন রতন।
ভারতীয় পুরাণের সঙ্গে মিশিয়ে দিচ্ছে লোকশিল্প এবং মেইতেই আঙ্গিক। মহাভারত থেকে শেক্সপিয়ার, রতনের ছোঁয়ায় অনায়াসে ফুটে উঠছে মঞ্চে। গড়ে উঠছে এক ভিন্ন এবং সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র নাট্যভাষ। অথচ সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হল চিরাচরিত নাটকের কী অদ্ভুত আধুনিক পরিবেশনা। আবার তারই মধ্যে মিশে ভারতীয় সংস্কৃতির মূল ধারা। রতনের নাটক দেখলে দীর্ঘদিন বিদেশে থাকা ভারতীয় অনুভব করতেন শিকড়ের টান।
প্রকৃতির সঙ্গে রাজনীতিকে নিবিড়ভাবে মিশিয়ে তৈরি করছেন ‘ঋতুসংহারম’। সেদিনের নাটকেই রতন ফুটিয়ে তুলেছিলেন মেইতেই বনাম কুকিদের অন্তর্দ্বন্দ্ব। শুধুই কি ‘ঋতুসংহারম’, সঙ্গে রয়েছে ‘চক্রব্যূহ’, ‘উত্তর প্রিয়দর্শী’, ‘অন্ধযুগ’ বলে শেষ করা যাবে না। ‘থিয়েটার অব রুটস’ বিপ্লব আসে রতনের হাত ধরে।
ন্যাশানাল স্কুল অব ড্রামায় পড়ার সময় রতন শিক্ষক হিসাবে পেয়েছিলেন ইব্রাহিম আলকাজির মতো মানুষকে। পরবর্তীতে হয়েছেন সেই এনএসডির চেয়ারপার্সন। ছিলেন সঙ্গীত নাটক আকাদেমির ভাইস চেয়ারম্যান। ১৯৮৭-১৯৮৯ সালে ছিলেন এনএসডির ডিরেক্টর। অসম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পেয়েছেন সাম্মানিক ডিলিট উপাধি। পেয়েছেন সঙ্গীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার। ২০১২ সালে রতন থিয়ামকে সম্মানিত করা হয় ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ সম্মান পদ্মশ্রী সম্মানে।
শেক্সপিয়র, গ্রিক নাটক, জাপানি নাট্যরীতি ‘নো থিয়েটার’ এবং নাট্যশাস্ত্রের এক অদ্ভুত প্রভাব দেখা যেত রতনের নির্দেশনায়। এ হেন নাট্যব্যাক্তিত্বের প্রয়াণ সততই বড় শূন্যস্থান তৈরি করে থিয়েটার জগতে। তবে এও সত্যি ভারতীয় থিয়েটারের আধুনিকরণের ইতিহাসে চিরকাল অমর হয়ে থাকবেন রতন থিয়াম। তাঁর সৃষ্টি যে যুগের পর যুগ দর্শকদের মননকে জাগিয়ে তুলবে, সন্দেহ নেই।


Post A Comment:
0 comments so far,add yours