সম্প্রতি চিনের বিদেশমন্ত্রকের মুখপাত্র মাও নিং দাবি করেছিলেন, দলাইয়ের উত্তরাধিকার সিদ্ধান্ত চিনকে বাদ দিয়ে হতে পারে না। চিনের আইন ও রীতিনীতি মেনেই মনোনয়ন হতে হবে। তবে এই দাবিকে উড়িয়ে দিয়েছে ভারত।
চিনকে নিঃশব্দে হারাতে ভারতের ‘ব্রহ্মাস্ত্র’ দলাই লামা
একটা ধর্মীয় পদ, যাকে ঘিরে দুই দেশের বিবাদ। একদিকে ভারত, অন্যদিকে চিন। আর মাঝে দ্য ফোরটিনথ দলাই লামা। যাঁকে ঘিরে বিশ্ব রাজনীতি এখন বিচলিত।
যৌনাঙ্গ দেখাতে বাধ্য করা সেই ছাত্রনেতা সৌভিক রায়ের কাছে গেল চিঠি, দলের সঙ্গে যোগাযোগ না রাখার নির্দেশ
শুধু বাংলা নয়, কেরল-বিহার-ওড়িশাতেও বনধের মিশ্র প্রভাব! ময়দানে আরজেডি-কংগ্রেসও
চতুর্দশ দলাই লামার বয়স হয়েছে। এবার নতুন মুখ খুঁজছে তিব্বত। যিনি হবেন বর্তমান দলাই লামা তেনজিং গ্যাস্ট্রোর উত্তরসূরি। কিন্তু তিনি কে? এই প্রশ্নটাই এখন পাক খাচ্ছে তিব্বতের আকাশে। যা দোলাচ্ছে আন্তর্জাতিক রাজনীতিও। দলাই লামা অবশ্য বলেছেন, তাঁর উত্তরাধিকার নিয়ে এখনও চিন্তার কিছু নেই। তিনি কমপক্ষে ১৩০ বছর বাঁচবেন। কিন্তু সূত্র বলছে, পরবর্তী দলাই লামা বাছাইয়ের কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। কাকে বাছাই করা হচ্ছে সেই নিয়ে কোনও ঘোষণা না করা হলেও, তলে তলে বেশ কয়েক জন বৌদ্ধিক শিশুকে নিয়ে এসে প্রশিক্ষণ ও যাচাই পর্বের কাজ শুরু হতে চলেছে। তারপর তাদের মধ্যে থেকে একজনকে বাছাই করে ঘোষণা হবে উত্তরসূরির নাম। এই ভাবেই বাছাই করা হয়েছিল বর্তমান দলাই লামা তেনজিং গ্যাস্ট্রোকেও।
দলাই লামা বাছাইয়ের লড়াইয়ে ভারত-চিন
সম্প্রতি চিনের বিদেশমন্ত্রকের মুখপাত্র মাও নিং দাবি করেছিলেন, দলাইয়ের উত্তরাধিকার সিদ্ধান্ত চিনকে বাদ দিয়ে হতে পারে না। চিনের আইন ও রীতিনীতি মেনেই মনোনয়ন হতে হবে। তবে এই দাবিকে উড়িয়ে দিয়েছে ভারত। ধর্মশালা থেকে কেন্দ্রীয় পরিষদীয় মন্ত্রী কিরেণ রিজিজু কারওর নাম না নিয়েই বলেন, উত্তরসূরি নির্বাচনের প্রক্রিয়া নিজের চিরাচরিত রীতি মেনেই চলবে। বর্তমান দলাই লামার ইচ্ছানুসারেই তা হবে। অন্য কেউ সেখানে নাক গলাতে পারবে না। ওয়াকিবহাল মহল বলছে, চিনের নাম করেই দলাই লামা নিয়ে ভারত নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেছে।
কিন্তু ভারত-চিন এখানে কীভাবে ঢুকে পড়ছে?
একজন ধর্মগুরু তাঁর উত্তরাধিকার নির্বাচন করবেন, সেখানে এই দুই দেশের কী কাজ? চিনই বা কোন সাহসে বলে, তাদের নিয়ম মেনেই এই বাছাই পর্ব হবে? সবটা জুড়ে অতীতের বেশ কিছু ঘটনার সঙ্গে।
বিশ্বজুড়ে কখনও সাম্রাজ্যবাদ ঘটিয়ে খ্রীস্ট ধর্ম, কখনও ইসলাম, কোথাও এক জোট থেকেছে সনাতনী হিন্দু। ধর্ম ও রাজত্বের চরিত্র কিছুটা এক। উপায় ভিন্ন হলেও বিস্তার বা ছড়িয়ে পড়ার বৈশিষ্ট্য উভয়ের মধ্যেই রয়েছে। তবে এত ধর্মের এদিক ওদিক বিস্তার ঘটলেও তিব্বত তা বরাবরই থেকেছে বৌদ্ধ ধর্মের মানুষের জায়গা। সেখানে অন্য কোনও ধর্ম নিজের জায়গা তৈরি করতে পারেনি। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই এলাকায় কোনও ধর্ম নিজের সাম্রাজ্যবাদ ঘটাতে পারেনি একটাই কারণে তা হল, এর ভৌগলিক অবস্থান। হিমালয় দ্বারা আবৃত তিব্বত বাহ্যিক দুনিয়া থেকে বরাবরই বিচ্ছিন্ন।
বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সর্বোচ্চ গুরু নির্বাচন বা এই দলাই লামা পদের যাত্রা শুরু হয় ১৩৯১ সালে। তিব্বতের প্রথম দলাই লামা হলেন জেনডান ড্রুপা। তবে তিনি এই পদ তাঁর মৃত্যুর পর পেয়েছিলেন। তাঁর সময়কালে মূলত ধর্মীয় সম্প্রীতি, তিব্বত জুড়ে বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তার এই সকল কাজই তিনি করেছিলেন। দলাই লামার প্রসঙ্গটা খানিকটা রাজনৈতিক হয় ১৫৭৮ সাল নাগাদ। সেই সময় দলাই লামা ছিলেন সোনম গেতসো। তিনিই প্রথম দলাই লামা যে কোনও রাষ্ট্রনেতার সঙ্গে নিরাপত্তা চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন।
ইতিহাস বলছে, এই ধর্মীয় নেতা তিব্বতের নিরাপত্তার জন্য সেই সময়কার মঙ্গোলিয়ান রাষ্ট্রনেতা আলতান খানের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। যার বিনিময়ে মঙ্গোলিয়ান সেনা তিব্বতে নিরাপত্তা প্রদান করতেন ও সেই দলাই লামা মঙ্গোলিয়ায় থাকা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে আলতান খানের গুণগান গাইতেন।
দলাই লামাদের ধর্ম মিশ্রিত যে রাজনৈতিক যাত্রা শুরু হয়েছিল, যা একটা অন্তর্বর্তী সরকারের রূপ পায় পঞ্চম দলাই লামা লবসং গ্য়াতসোর সময়। তিনি প্রথম দলাই লামা যিনি মঙ্গোলিয়ান সেনাকে ব্যবহার করে তিব্বতের অন্দরে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করেছিলেন। সেই সময় চিনে কোনও সরকার ছিল না। কমিউনিস্টরাও আসেনি। তিব্বত-সহ পার্শ্ববর্তী একাধিক অংশ, এমনকি ভারতের অরুণাচল প্রদেশ ও সিকিম তখন ছিল চিনের কিং সাম্রাজ্যের অংশ। রাজ রাজত্বের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার যা ধর্মের ভিত্তিতে তৈরি হওয়ার কারণে তাতে বিশেষ আপত্তি ছিল না তাদের।
সমস্যার সূত্রপাত ১৯১২ সাল। কিং সাম্রাজ্যের পতন। গোটা চিনজুড়ে সামন্ততন্ত্রের সূচনা। যা চক্ষুশূল হয়ে ওঠে মাও জে দং-এর। দেশজুড়ে শুরু হয় আন্দোলন। সশস্ত্র আন্দোলন। গঠন হয় নতুন সরকার। কিং সাম্রাজ্যের পর ছোট ছোট সামন্ততন্ত্রে বিভক্ত হওয়া চিনকে এক সরকারের আওতায় আনার বার্তা দেন মাও জে দং।
অন্যদিকে তিব্বত, সেখানে আবার ততদিনে স্বাধীনতার মাদল বেজে উঠেছে। চিন থেকে নিজেদের আলাদা করতে মরিয়া হয়ে পড়েছেন তৎকালীন দলাই লামা। যা নজরে পড়ে মাও জে দংয়ের। সেই থেকেই শুরু হয় বিবাদ।
তিব্বতকে কেন স্বাধীন তকমা কেন দিতে চায় না চিন?
একটি কারণ, যা এতক্ষণ ধরে আলোচনা হল অর্থাৎ সেই রাজতন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদের স্মৃতি। অন্য়টি ভৌগলিক ও বাণিজ্যিক। এক দিকে তিব্বত যা তাদের বাহ্যিক দুনিয়া থেকে রক্ষা করছে। হিমালয় ঢাল হয়ে কাজ করছে। অন্যদিকে, যাকে হাং চিন বলা হয়। যে দিকটা অনেকটা উপকূলীয়বর্তী হওয়ার কারণে সর্বদা নিরাপত্তার একটা ঝুঁকি থাকে। ১৮৯৪ সালে জাপান যখন চিনে হামলা চালিয়েছিল, তারা এই উপকূল অংশকেই ব্যবহার করেছিল। অর্থাৎ চিন যদি সংঘাতে যায়, তা হলে মাথা বাঁচানোর একটা যাতে জায়গা থাকে সেই কথা মাথায় রেখেই তিব্বতকে ধরে রাখা। এছাড়াও, এই হিমালয় ঘেরা অংশেই রয়েছে সবচেয়ে বড় লিথিয়াম খনি। ফলত একটা বাণিজ্যিক মুনাফাও থাকছে। এমনকি এশিয়ার তথা চিনের সবচেয়ে বড় নদীগুলোর উৎপত্তি স্থলও এই তিব্বত।
দলাই লামার সঙ্গে সংঘাত
পূর্বতন দলাই লামাদের মতোই চিনের সরকারের বিরুদ্ধে সুর চড়িয়ে স্বাধীন তিব্বতের দাবি জানিয়েছিলেন বর্তমান দলাই লামাও। যার মাশুল তাঁকে গুণতে হয়েছে। তাঁর উপর হামলার ছক কষেছে শি জিনপিং সরকার। বর্তমান দলাই থাকেন ভারতেই। রাজনৈতিক শরণার্থী হয়ে এই দেশে গভীর রাতে পালিয়ে আসতে হয়েছিল তাঁকে। স্বাধীনতার দাবিতে যখন তিনি ক্রমাগত সুর চড়িয়ে যাচ্ছেন, তার পরিণাম ভুগতে হয়েছিল তিব্বতবাসীদের। ১৯৫৯ সালে তাদের উপর অকথ্য অত্যাচার চালিয়েছিল চিনা সেনা। প্রাণে মারার চেষ্টা করেছিল দলাই লামাকে। তখন ছদ্মবেশে তিব্বত থেকে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন তেনজিং গ্যাস্ট্রো। সেই থেকে এখানেই রয়েছেন তিনি। যে কারণে চিনের আরও চক্ষুশূল হয়ে উঠেছে ভারত।
ভারতের কী লাভ?
চিনের আগ্রাসনের কারণে কানাঘুষো শোনা যাচ্ছে, সম্ভবত পরবর্তী দলাই লামা ভারত থেকেই বাছাই হবে। ফলত, চিনের বিরুদ্ধে কোনও শব্দ খরচ বা অস্ত্র ব্যবহার না করেই জিতে যাবে ভারত। এছাড়াও, আন্তর্জাতিক পরিসরে চিনের আগ্রাসী ভাবমূর্তিকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে দলাই লামা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। কারণ বৌদ্ধ ধর্মের মানুষ এখন আর শুধু তিব্বত নয়, গোটা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে চিনের আগ্রাসন, ভারতের ঢাল হয়ে দাঁড়ানো দিনশেষে বিশ্ব মঞ্চে এই দেশকেই বাড়তি ডিভিডেন্ড দেবে।


Post A Comment:
0 comments so far,add yours