আপাতত ওই ওবিসি জটে আটকে নিয়োগ থেকে ভর্তি। হাইকোর্ট আগেই জানিয়ে দিয়েছিল, শংসাপত্র ব্যবহার করে যাঁরা সংরক্ষণের সুবিধা পেয়েছেন, এই নির্দেশে তাঁদের উপর কোনও প্রভাব পড়বে না। এই শংসাপত্র ব্যবহার করে যাঁরা চাকরি পাওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছেন, তাঁদেরও চিন্তার কোনও কারণ নেই। তবে নতুন করে আর কেউ এই শংসাপত্র চাকরিপ্রক্রিয়ায় ব্যবহার করতে পারবেন না।
OBC কারা? জট কোথায়? কেন বারবার ধাক্কা খাচ্ছে রাজ্য?
গত বছর কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশের পর থেকেই পশ্চিমবঙ্গে জটিলতা অব্যাহত। কারা ওবিসি, কারা নয়, কারা চাকরি বা ভর্তির ক্ষেত্রে সুবিধা পাবে, কারা নয়- এই বিষয় নিয়ে জট কাটছেই না। ৫ লক্ষ ওবিসি(OBC) শংসাপত্র বাতিল হয়ে যাওয়ার পর থেকে আটকে আছে বহু নিয়োগ, আটকে আছে কলেজের ভর্তি প্রক্রিয়াও। এরই মধ্যেই আরও একটি মামলার রায় জট বাড়িয়ে দিয়েছে আরও। ওবিসি(OBC) শংসাপত্র নিয়ে কোথায় গেরো? কেন এত সমস্যা?
এই অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি (OBC) কী?
এটিও পড়ুন
বড় ধাক্কা রাজ্যের, ভাতা দেওয়া যাবে না, অন্তর্বর্তী স্থগিতাদেশ হাইকোর্টের
সুচিত্রা সেনকে মন্দিরে ঢুকতে বাধা, মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলেন দারোয়ান! কেন জানেন?
আদালতের কড়া নির্দেশ, জেলের ভিতরই নির্যাতিতাকে বিয়ে করলেন গায়ক নোবেল!
যে সব সম্প্রদায় শিক্ষাগত এবং সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া, তাদের অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ওই শ্রেণির উন্নয়নের জন্য সরকারি চাকরি ও উচ্চশিক্ষায় সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। উল্লেখ্য, ‘অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি’ ভুক্তদের সংরক্ষণের সুবিধা দিতে রাজ্য সরকারের তরফে যে শংসাপত্র দেওয়া হয়, সেটাই হল ওবিসি সার্টিফিকেট।
মণ্ডল কমিশনের ১৯৮০ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, সেই সময় দেশের ৫২ শতাংশ মানুষ ওবিসি তালিকাভুক্ত ছিল। ২০০৬ সালে ন্যাশনাল স্যাম্পেল সার্ভে অর্গানাইজেশন হওয়ার পর সেই সংখ্যা কিছুটা কমে হয় ৪২ শতাংশ। এই তালিকায় থাকা নাগরিকেরা সরকারি চাকরি ও উচ্চশিক্ষায় সংরক্ষণের সুবিধা পান।
মূলত সামাজিক অবস্থান, শিক্ষা এবং আর্থিক অবস্থান বিবেচনা করেই কোনও সম্প্রদায়কে অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণিভুক্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
পশ্চিমবঙ্গে অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণিভুক্ত কারা?
পশ্চিমবঙ্গে অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির তালিকায় রয়েছে ১৭৯টি সম্প্রদায়। আর এই তালিকাকে দুটি ক্যাটেগরিতে ভাগ করা হয়েছে। ক্যাটেগরি-এ এবং ক্যাটেগরি-বি। ক্যাটেগরি-এ হল অতি অনগ্রসর ও ক্যাটেগরি-বি হল অনগ্রসর।
ক্যাটেগরি-এ-তে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ৮১টি জাতি। যার মধ্যে ৭৩টি জাতি মুসলিম। তার মধ্যে রয়েছে বৈদ্য মুসলিম, ব্যাপারী মুসলিম, মুসলিম ছুতোর মিস্ত্রি, মুসলিম দফাদার, গায়েন মুসলিম, মুসলিম জমাদার, মুসলিম কালান্দার, কসাই, মাঝি (মুসলিম), খানসামার মতো জাতিভুক্তরা।
ক্যাটেগরি-বি’তে রয়েছে ৯৮টি জাতি। এর মধ্যে ৪৫টি মুসলিম। ক্যাটেগরি-বি বৈশ্য কাপালি, বংশী বর্মণ, বারুজীবী, চিত্রকর, দেওয়ান, কর্মকার, কুর্মি, মালাকার, ময়রা, গোয়ালা, তেলির মতো জাতিভুক্তরা রয়েছে।
ওবিসি শ্রেণিভুক্তদের কী সুবিধা পাওয়া যায়?
পশ্চিমবঙ্গে সরকারি চাকরিতে অনগ্রসর শ্রেণির জন্য ১৭ শতাংশ সংরক্ষণ রয়েছে। তার মধ্যে ক্যাটেগরি-এ শ্রেণিভুক্তরা ১০ শতাংশ সংরক্ষণের সুবিধা পান। আর ক্যাটেগরি-বি শ্রেণিভুক্তরা ৭ শতাংশ সংরক্ষণের সুবিধা পান।
একটি মামলার পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনে রাজ্যকে জাতীয় অনগ্রসর শ্রেণি কমিশন ওবিসি-দের সংরক্ষণ বাড়িয়ে ২২ শতাংশ করার সুপারিশ করেছিল। তবে রাজ্য সরকার এই নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নেয়নি।
বাতিল হয়েছিল লক্ষ লক্ষ শংসাপত্র
গত বছর মে মাসে ২০১০ সালের পর জারি হওয়া সমস্ত ওবিসি (অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি) শংসাপত্র বাতিলের নির্দেশ দেয় কলকাতা হাইকোর্ট। যথাযথভাবে আইন মেনে শংসাপত্র বানানো হয়নি বলে জানিয়ে দেয় আদালত। বাতিল হয়ে যায় ৫ লক্ষ ওবিসি সার্টিফিকেট। জানিয়ে দেওয়া হয় যে রাজ্যের আইনসভা অর্থাৎ বিধানসভাকে ঠিক করতে হবে যে কারা ওবিসি।
কেন বাতিল করা হয় ওবিসি সার্টিফিকেট?
অভিযোগ ছিল, ২০১০ সালের পর রাজ্যে যে সমস্ত ওবিসি সার্টিফিকেট তৈরি করা হয়েছে, তা যথাযথভাবে আইন মেনে বানানো হয়নি।
২০১০ সালে একটি অন্তর্বর্তী রিপোর্টের ভিত্তিতে পশ্চিমবঙ্গে ‘অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি’ তৈরি করেছিল বামফ্রন্ট সরকার। যার নাম দেওয়া হয় ‘ওবিসি-এ’। ২০১১ সালে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর সেই অনগ্রসর শ্রেণি সংক্রান্ত চূড়ান্ত রিপোর্ট ছাড়াই একটি তালিকা তৈরি করে এবং আইন প্রণয়ন করে। তার ভিত্তিতেই মামলা হয় হাইকোর্টে।
আরও অভিযোগ ছিল যে, তৃণমূল সরকার সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা ১৯৯৩ সালের ওয়েস্ট বেঙ্গল ব্যাকওয়ার্ড ওয়েলফেয়ার কমিশনের আইনের পরিপন্থী। এর ফলে সরকারি সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন প্রকৃত পিছিয়ে পড়া অংশের মানুষেরা। তাই সরকার যেন ওই আইন মেনেই শংসাপত্র দেয়, এ কথাই বলেছিল হাইকোর্ট।
আসল নিয়মটা কী? কোথায় গলদ রাজ্যের?
আইনজীবী বিক্রম চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন, সুপ্রিম কোর্টের ৯ বিচারপতির বেঞ্চ যে রায় দিয়েছিল, সেখানে বলা হয়েছিল কমিউনিটি বা কোনও গ্রুপকে ওবিসি তকমা দিতে গেলে পুরো পপুলেশন সার্ভে করতে হয়। যে সম্প্রদায় আবেদন করবে, সেই সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে আলাদা করে সার্ভে করে দেখতে হবে যে ক্রাইটেরিয়া বা মাপকাঠির সঙ্গে মিলছে কি না। তিনি আরও জানিয়েছেন, সবার আগে একটা মাপকাঠি ঠিক করতে হবে। পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষাগত যোগ্যতা ও আর্থিক ক্ষমতার একটা গড় বের করতে হবে। সেটাই হবে মাপকাঠি। তার নীচে থাকলে অনগ্রসর শ্রেণি হিসেবে গণ্য হবে।
পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে বাম আমলে সেই সমীক্ষা শুরু হয়েছিল। কিন্তু শেষ করা যায়নি। আর তৃণমূল পুরো জনসংখ্যার উপর সমীক্ষা না করে কয়েকটি পরিবারের তথ্য নিয়েই ওবিসি তকমা দিচ্ছে বলে অভিযোগ। শুধু তাই নয়, মাত্র দেড় মাসে কীভাবে ১৪০টি সম্প্রদায় বা জাতিকে চিহ্নিত করা হল, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন আইনজীবী।
আইন তৈরি করেও ধাক্কা খেয়েছে রাজ্য
তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর বিধানসভায় ওবিসি সংক্রান্ত একটি আইন পাশ হয়। সেই আইনে বলা হয়, ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল ব্যাকওয়ার্ড ক্লাস কমিশনে’র বাইরে গিয়েও সরকার নিজে সমীক্ষা করে ওবিসি চিহ্নিত করে দিতে পারবে। সাধারণত কমিশন সুপারিশ করে ও রাজ্য ঠিক করে সেটা মানা হবে কি না। এর জন্য আলাদা আইন তৈরি করার প্রয়োজন ছিল না বলে মত আইনজীবীদের। পরে কলকাতা হাইকোর্টও ওই আইনের বিধানের উপর স্থগিতাদেশ দেয়।
নতুন মামলায় যা রায় দিল হাইকোর্ট…
আদালতের নির্দেশ মেনে নতুন বিজ্ঞপ্তি জারি করেছিল রাজ্য সরকার। সেই বিজ্ঞপ্তিতেই এবার অন্তর্বর্তী স্থগিতাদেশ দিল হাইকোর্ট। ১৪০টি জনজাতিকে নিয়ে নতুন বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল।
রাজ্যের বিরুদ্ধে আবার কী অভিযোগ উঠল?
হাইকোর্টের প্রথম নির্দেশের পর সেটা মেনে নতুন করে তালিকা তৈরি করতে শুরু করে রাজ্য সরকার। অভিযোগ, সেখানে কোর্টের নির্দেশ অমান্য করে তড়িঘড়ি নতুন ওবিসি তালিকা প্রকাশ করা হচ্ছে।
শুনানিতে বিচারপতিরা জানান, ২০১২ সালের ওবিসি আইন অনুযায়ী অর্ধেক কাজ করে, আবার ১৯৯৩ সালের আইনে ফেরত গিয়েছে রাজ্য। যে চার থেকে পাঁচটি বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে, তার সবকটিতেই নির্দেশ অমান্য করা হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন বিচারপতি। তাই আপাতত ওই বিজ্ঞপ্তি কার্যকর হবে না।
মামলাকারীদের বক্তব্য ছিল, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পেশাগতভাবে ভিন্ন রাজ্যের প্রতিটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে সমীক্ষা করার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু রাজ্য জেলাভিত্তিক কয়েকটি পরিবারের মধ্যেই সমীক্ষা করেছে।
ওবিসি বিজ্ঞপ্তি নিয়ে কী বলছে রাজ্য?
রাজ্য বলছে, হাইকোর্টের নির্দেশ মেনেই ওবিসি বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়ও বলেছেন, মণ্ডল কমিশন মেনেই এই বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে। আপাতত আইনি পরামর্শদাতারা খতিয়ে দেখছেন বিষয়টি।
কী এই মণ্ডল কমিশন?
মোরারজি দেশাই প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন বি পি মণ্ডলের নেতৃত্বে এই মণ্ডল কমিশন গঠন করা হয়। ১৯৮০ সালে সেই কমিশন তৈরি হয় ওবিসি-দের চিহ্নিত করার জন্য। ওই কমিশন মোট ৩,৭৪৩টি জাতি ও সম্প্রদায়কে ওবিসি হিসেবে চিহ্নিত করে সেই কমিশন অনুসারেই নতুন তালিকা প্রস্তুত করছে রাজ্য।
মণ্ডল কমিশনেরও আগে ছিল কালেলকর কমিশন
১৯৫৩ সালে কাকা কালেলকরের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল এই কমিশন। ১৯৫৫-তে কমিশনের রিপোর্ট জমা পড়ে। ২৩৯৯ টি জাতিকে চিহ্নিত করা হয়েছিল সেখানে। এর মধ্যে অতি অনগ্রসর ছিল ৮৩৭টি। তবে সেই সমীক্ষার রিপোর্ট ওবিসি চিহ্নিতকরণে কার্যকর করেনি সরকার।
আপাতত ওই ওবিসি জটে আটকে নিয়োগ থেকে ভর্তি। হাইকোর্ট আগেই জানিয়ে দিয়েছিল, শংসাপত্র ব্যবহার করে যাঁরা সংরক্ষণের সুবিধা পেয়েছেন, এই নির্দেশে তাঁদের উপর কোনও প্রভাব পড়বে না। এই শংসাপত্র ব্যবহার করে যাঁরা চাকরি পাওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছেন, তাঁদেরও চিন্তার কোনও কারণ নেই। তবে নতুন করে আর কেউ এই শংসাপত্র চাকরিপ্রক্রিয়ায় ব্যবহার করতে পারবেন না। ডিভিশন বেঞ্চ তার নির্দেশে স্পষ্ট করে বলেছে যে, ৬৬ টি সম্প্রদায়কে নিয়ে এবং ৭ শতাংশ সংরক্ষণ নীতি মেনে কাজ করার কথা। কলকাতা হাইকোর্টেই অন্য একটি মামলায় বিচারপতি ওই হিসেব মাথায় রেখে নিয়োগ শুরু করার কথা বলেছেন।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours