কীভাবে ধীরে ধীরে অবনতি হল ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক?
ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কে চিড় ধরল কীভাবে?



একদিন যে দেশের স্বাধীনতার জন্য ভারত লড়েছে, আজ সেই দেশই ভারত ভাগের ফন্দি আঁটছে। ফের চর্চায় ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক। ফাটল ধরেছে দুই দেশের সম্পর্কে। কিন্তু এমন তো সম্পর্ক ছিল না। দুই বছর আগেও যদি ফিরে দেখা যায়, তাহলে দেখা যাবে দুই দেশের মধ্যে যথেষ্ট বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। বরং বলা যায়, স্নেহশীল অভিভাবকের মতোই বাংলাদেশকে আগলে রেখেছিল ভারত। তাহলে এই সম্পর্কে ফাটল ধরল কীভাবে? যে দেশকে ভারত সাহায্য না করলে আজ তারা পাকিস্তানের থেকে স্বাধীনই হত না, তারা কেন ভারতের অবদান অস্বীকার করছে রাতারাতি? এটা কি দুই দেশের বিরোধ নাকি কোনও ব্যক্তি বিশেষের ইগোর জন্য মাশুল দিতে হচ্ছে নিরাপরাধ সাধারণ মানুষকে?


১৭ মে ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্য দফতর জানিয়েছে, ভারতের বেশ কয়েকটি বন্দর দিয়ে বাংলাদেশি রেডিমেড পোশাক, প্রক্রিয়াজাত খাবার, ফল, তুলা, প্লাস্টিক, পিভিসি পণ্য ও কাঠের আসবাবপত্র ভারতে আমদানি করা যাবে না। মনে করা হচ্ছে, ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে বাংলাদেশ যেভাবে পাকিস্তানের হয়ে গলা ফাটিয়েছে, তারই জবাব এটা। তবে ভারত কিন্তু প্রথমে বাণিজ্যের দরজা বন্ধ করেনি। পদ্মার ইলিশের রফতানি বন্ধ করে ঝামেলাটা পাকিয়েছিলেন মহম্মদ ইউনূসই। তবে সংঘাতের সূচনা আরও আগে থেকে। কীভাবে আজকের সম্পর্ক তলানিতে পৌঁছল, তা-ই দেখা যাক –

শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন দুই দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক ছিল। একাধিক বাণিজ্য ও অন্যান্য দ্বিপাক্ষিক চুক্তিও হয়েছিল। তখন কোনওদিন বাংলাদেশ অস্বীকার করেনি তাদের স্বাধীনতায় ভারতের অবদান। প্রতি বছর বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে ভারতকেও ধন্যবাদ জানানো হত। তাহলে এই ঝগড়া বাধাল কে?

হাসিনার পতন থেকেই শুরু-
২০২৪ সালের জুন-জুলাই মাসে অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশ। কোটা সংরক্ষণ নিয়ে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তা বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘রাজাকার’ মন্তব্যে জন আন্দোলনের রূপ নেয়। বাংলাদেশের এই আন্দোলনে নাক গলায়নি ভারত। গত বছরের ৫ অগস্ট গণ আন্দোলনের মুখে পড়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন শেখ হাসিনা। ইস্তফা দেন প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে। বাংলাদেশে তখন কোনও সরকার নেই। আন্দোলনকারীরাই নোবেলজয়ী মহম্মদ ইউনূসকে দায়িত্ব দেন অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের। তিনিই সরকারের প্রধান উপদেষ্টা পদে বসেন। ভারত এই অন্তর্বর্তী সরকারকেও আহ্বান জানিয়েছিল সুসম্পর্ক স্থাপনের। কিন্তু গোল বাধে অন্য জায়গায়।

বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন শেখ হাসিনা। কূটনীতির শর্তেই ভারত অ্যাসাইলাম বা আশ্রয় দেয়। এটা ভারতের বিদেশনীতি। শেখ হাসিনার জায়গায় অন্য কোনও বন্ধু দেশের রাষ্ট্রপ্রধানও যদি আশ্রয় চাইতেন, তাহলে ভারত এই নীতিই গ্রহণ করত। কিন্তু ভারত হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়াতেই আপত্তি বাংলাদেশের। বিশেষ করে মহম্মদ ইউনূসের। তিনি দাবি জানিয়েছেন, শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠাতে হবে বাংলাদেশে। এর জন্য ইন্টারপোলের দ্বারস্থও হয়েছেন। এখান থেকেই সম্পর্কের অবনতি শুরু।

হিন্দুদের উপরে অত্য়াচার-
শেখ হাসিনার আওয়ামী লিগ সরকারের পতন ও মহম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের গঠনের পরই ওপার বাংলায় একটা বড় পরিবর্তন হয়। সংখ্যালঘুদের উপরে অত্য়াচার চরমে ওঠে। বিশেষ করে হিন্দু পরিবারদের বাড়িঘর-দোকান ভাঙচুর, আগুন লাগিয়ে দেওয়া, প্রকাশ্যে খুনের মতো ঘটনা দিন-প্রতিদিন বাড়তেই থাকে। হিন্দুদের উপরে এই অত্যাচার চরমে ওঠায় উদ্বেগ প্রকাশ করে ভারত। কিন্তু চোখের সামনে সব অত্যাচার দেখেও নিরুত্তাপ রয়েছে ইউনূস সরকার। এখনও সেই হিংসা থামেনি।

ইলিশ যুদ্ধ-
ভারত-বাংলাদেশের সু-সম্পর্কের অন্যতম ভিত ছিল পদ্মার ইলিশ। ইউনূস ক্ষমতায় আসতেই ঘোষণা করে, ভারতে ইলিশ পাঠানো হবে না। পুজোর সময় ভারতে ইলিশ রফতানি করায় দেশে মাছের দাম বেড়ে যায়। বাংলাদেশের মানুষকে সস্তায় ইলিশ খাওয়াতে এই সিদ্ধান্ত। যদিও পরে চাপের মুখে পড়ে অল্প পরিমাণে ইলিশ পাঠাতে রাজি হয় বাংলাদেশ।

উত্তেজনার সময় যখন ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত বন্ধ করা হয়েছিল অনুপ্রবেশের আশঙ্কায়, সেই সময় বাংলাদেশে ব্যাপক প্রভাব পড়েছিল। শেষে ভারতই দরজা খুলে আলু-পেঁয়াজের মতো নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী দিয়ে সাহায্য করে। কিন্তু বাংলাদেশ ঠিক উল্টোটাই করেছে। ভারতের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে তারা অন্য বিকল্প খুঁজেছে। কোনও দেশ বাণিজ্যে বিকল্প খুঁজতেই পারে। কিন্তু ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ও বাণিজ্য কার্যত অস্বীকার করা কোনও সুষ্ঠ, সংগঠিত দেশের অবস্থান হতে পারে না।

বাংলা দখলের হুমকি-
মহম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের পিছনে যেমন বিএনপি-র সমর্থন ছিল, তেমনই আবার উগ্র মৌলবাদী সংগঠন, জামাত-ই-ইসলামির মতো দলগুলির সমর্থনও ছিল। এই উগ্রপন্থী সংগঠনগুলিই সরকার বদলের পর থেকে বাংলা দখলের হুমকি দিতে থাকে। কখনও কলকাতা দখল, কখনও আবার উত্তর-পূর্বের সেভেন সিস্টার্স দখলের হুমকি দেয়। ভারতও চুপ করে থাকেনি। এই উসকানিমূলক কার্যকলাপের তীব্র বিরোধিতা করে। বাংলাদেশকে সংযত হতে বলে। কিন্তু বাংলাদেশ উসকানি থামায়নি।

উত্তর-পূর্বে কুনজর-
গত মার্চে চিন সফরে গিয়ে মহম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের আধিপত্য বড়াই করতে গিয়ে দাবি করেন, সেভেন সিস্টার্স চারিদিক থেকে আবদ্ধ। বাংলাদেশ ছাড়া তাদের যাওয়ার কোনও উপায় নেই। সমুদ্রের অভিভাবক বাংলাদেশ। আবার দিন কয়েক আগে নেপাল, ভুটানের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়ানোর প্রসঙ্গেও সেভেন সিস্টার্সের প্রসঙ্গ টেনে আনেন ইউনূস।

যদিও এই সেভেন সিস্টার্স নিয়ে দাবি করে আগেই ঢোঁক গিলতে হয়েছে বাংলাদেশকে। ইউনূসের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত প্রাক্তন সেনাকর্তা ফজলুর রহমানও ভারতের সাত রাজ্য় দখলের হুমকি দিয়েছিলেন। এই মন্তব্যকে ভালভাবে নেয়নি ভারত। আর তারপরই চাপে পড়ে বাংলাদেশের বিদেশ মন্ত্রক রীতিমতো বিবৃতি দিয়ে বলে যে, এটা কোনও ভাবেই বাংলাদেশের সরকারি নীতির পরিপন্থী নয়।

পাকিস্তানের সঙ্গে দোস্তি-
দুই দেশের সম্পর্কে অবনতির ক্ষেত্রে আরও একটা বড় কারণ হল পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সখ্য বাড়ানো। যে দেশ থেকে এক সময়ে আলাদা হয়েছিল বাংলাদেশ, সেই দেশই ইউনূস জমানায় ভোল বদলে পাকিস্তানের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছে, ভারতের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক মন্তব্য থেকে শুরু করে কার্যকলাপে মদত দিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই ভারত এই সমীকরণকে ভালভাবে নেয়নি।

এবার প্রশ্নটা হল, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার কোনও নির্বাচিত সরকার নয়। তাই জনগণের প্রতিনিধিত্ব করার দায়বদ্ধতাও নেই। ফলে ব্যক্তিবিশেষের স্বার্থে গোটা দেশ পরিচালিত হচ্ছে। তবে এমনটা হতে পারে না। কোনও নির্বাচিত সরকার বিদেশনীতি নির্ধারণ করতে পারে কি?
Share To:

kakdwip.com

Post A Comment:

0 comments so far,add yours