বাংলাদেশের পরিবর্তিত পটভূমিতে নির্বাচন হলে, তার ফলাফল কী হবে, তা নিয়ে ঘোর সংশয় রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারকে আনা হয়েছিল সংস্কারের জন্য, কিন্তু চোখে পড়ার মতো সংস্কার তেমন কিছুই হয়নি।
নিষিদ্ধ আওয়ামী লিগ, ব্যুমেরাং হবে না তো ইউনূসের কাছে?
বাংলাদেশের রাজনীতির কথা বললেই প্রথমে সবার মনে আসে একটাই দলের নাম, আওয়ামী লিগ। বাংলাদেশের সবথেকে পুরনো দল আওয়ামী লিগ। ১৯৪৯ সালে পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা চাইত বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান)। সেই স্বাধীনতার দাবি থেকেই ধীরে ধীরে রাজনৈতিক দলের রূপ নেয়, তৈরি হয় আওয়ামী লিগ। শেষে ১৯৭১ সালে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ। সেই বাংলাদেশেই আজ ‘নিষিদ্ধ’ আওয়ামী লিগের সমস্ত রাজনৈতিক কার্যক্রম। নির্বাচন কমিশন বাতিল করে দিয়েছে শেখ হাসিনার দলের রেজিস্ট্রেশনও। ফলে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনেও অংশ নিতে পারবে না। এই কাজ করে কি আসলে পথের কাটা সরালেন মহম্মদ ইউনূস?
মহম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার গত ১২ মে নির্দেশিকা জারি করে জানানো হয় যে আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনালে শেখ হাসিনা ও তাঁর দলের সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা চলাকালীন আওয়ামী লিগ কোনও রাজনৈতিক কার্যক্রমে অংশ নিতে পারবে না। এমনকী, অনলাইনেও কোনও রাজনৈতিক কর্মসূচি করতে পারবে না। এর আগে গত বছরের নভেম্বর মাসে আওয়ামী লিগের ছাত্র সংগঠন, ছাত্র লীগের উপরেও নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল অন্তর্বর্তী সরকার।
আওয়ামী লিগের রাজনৈতিক কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা জারির ঘোষণায় বলা হয়েছে, ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি সরকার গঠনের পর থেকে ২০২৪ সালের ৫ অগষ্ট পর্যন্ত ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হওয়া বাংলাদেশ এবং শাখা সংগঠনগুলির উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হচ্ছে। হামলা, গুম করে খুন, গণহত্য়া, আটক, গ্রেফতার, নির্যাতন, ধর্ষণ সহ একাধিক অভিযোগ রয়েছে। আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনালে শুনানি শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনও রাজনৈতিক কার্যক্রমে অংশ নিতে পারবে না।
কেন হঠাৎ আওয়ামী লিগের উপরে খাঁড়া নামল?
২০২৪ সালে গণ-অভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে আওয়ামী লিগের সরকার। দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আওয়ামি লীগের সদস্যদের উপরে নির্মম অত্যাচার, দলীয় কার্যালয়ে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। এরপরও ক্ষান্ত হয়নি ইউনূস সরকার ও দেশের জনগণের একাংশ।
বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার রয়েছে বর্তমানে। আজীবন তো আর সরকার চালাতে পারে না অন্তর্বর্তী সরকার। আর নির্বাচনের কথা উঠতেই একাংশের মধ্যে আওয়ামী লিগ নিয়ে ভয় তৈরি হয়েছে। যদি ফের নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় ফেরে আওয়ামী লিগ!
সেই কারণেই দীর্ঘদিন ধরেই আওয়ামী লিগ নিষিদ্ধ করার দাবি উঠছিল। গত ৮ মে প্রথম এনসিপির মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ কয়েকশো নেতা-কর্মী নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা মহম্মদ ইউনূসের বাসভবন যমুনার সামনে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করে। পরে জামাত সহ ইসলামপন্থী বিভিন্ন দলের নেতা-কর্মীরাও যোগ দেয়। শুক্রবার সন্ধ্যায় ঢাকার শাহবাগ মোড়ে অবস্থান শুরু হয়। এরপরই শনিবার রাতে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ জরুরি বৈঠক করে এবং আওয়ামী লিগের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়।
আওয়ামী লিগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়ায় লাভ কার?
জামাত সহ উগ্র ইসলামপন্থী দলগুলি আওয়ামী লিগের উপরে নিষেধাজ্ঞার দাবি করলেও, বাংলাদেশের মূল রাজনৈতিক দলগুলি কখনওই সরাসরি হাসিনার দল নিষিদ্ধ করার দাবি জানাননি। একাধিকবার বিভিন্ন বিএনপি নেতারা বলেছেন যে তারা কোনও রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের পক্ষে নন। যদিও ইউনূস সরকারের এই সিদ্ধান্তের পর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল আলমগীর বলেছেন, এই সিদ্ধান্তে তারা আনন্দিত।
সোজা হিসাব দেখতে গেলে, রেজিস্ট্রেশন বাতিল হওয়ায় আওয়ামী লিগ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। সেক্ষেত্রে বিএনপি-র একটা প্রতিদ্বন্দ্বী কমল। নির্বাচনে তাদের ভোটব্যাঙ্ক বাড়বে। এনসিপি, জামাত-এ ইসলামির মতো দলও লাভবান হবে।
বাংলাদেশের পরিবর্তিত পটভূমিতে নির্বাচন হলে, তার ফলাফল কী হবে, তা নিয়ে ঘোর সংশয় রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারকে আনা হয়েছিল সংস্কারের জন্য, কিন্তু চোখে পড়ার মতো সংস্কার তেমন কিছুই হয়নি। অন্যদিকে আওয়ামী লিগের বিশ্বস্ত যে ভোটব্যাঙ্ক রয়েছে, তারাও সংখ্যালঘুদের উপরে অত্যাচার দেখে বিএনপি বা অন্য কোনও দলের উপরে আস্থা রাখবে না। সেক্ষেত্রে শেখ হাসিনার আওয়ামী লিগ পথ থেকে সরে গেলে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলি বিশেষ সুবিধা করতে পারবে না।
বিএনপির সঙ্গে যদি সরাসরি আওয়ামী লিগের লড়াই হত, তবে জনগণের ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতায় আসতে সুবিধা হত। কিংবা জামাতের নির্বাচনে লড়তে সুবিধা হত। কিন্তু আওয়ামী লিগকেই নির্বাচনের আঙিনা থেকে সরিয়ে দেওয়ায়, তার সমর্থকদের ভোট এই কোনও দলের দিকে চলে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে আবার এই সিদ্ধান্ত বুমেরাং হয়ে যেতে পারে।
অন্তর্বর্তী সরকারের কী লাভ?
অনেকেই বলছেন, আন্দোলনের মুখে পড়েই অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লিগের কার্যক্রমের উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। যদিও অন্তর্বর্তী সরকারের দাবি, আন্দোলনের সঙ্গে সরকারের সিদ্ধান্তের কোনও যোগ নেই। আগামী নির্বাচন কবে হবে, তা নিয়ে টালবাহানা করে যাচ্ছে ইউনূস সরকার। বিএনপি সহ একাধিক দলই চলতি বছরেই নির্বাচনের দাবি করেছে, কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার সে বিষয়ে কোনও সদুত্তর দিতে পারেনি। ইউনূস সরকার আশ্বাস দিয়েছে, ২০২৬ সালের জুন মাসের মধ্যে নির্বাচন হবে। যদিও সরকারের কাজকর্মে তার প্রভাব নেই।
আওয়ামী লিগ নিষিদ্ধ করায় কার্যত বিরোধী দলগুলিকে একজোট করতে পেরেছে অন্তর্বর্তী সরকার। আপাতত কিছুদিন নির্বাচনের বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে থাকবে। অনেকে আবার মহম্মদ ইউনূসকে ‘ক্ষমতালোভী’র তকমা দিয়েছে। আওয়ামী লিগকে নিষিদ্ধ করে আসলে ইউনূস তাঁর নিজের রাস্তাই সাফ করলেন বলে দাবি একাংশের।
আওয়ামী লিগ কী বলছে?
অন্তর্বর্তী সরকার যতই কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা জারি করুক না কেন, আওয়ামী লিগ এই সিদ্ধান্ত মানতে নারাজ। তারা এই নিষেধাজ্ঞা মানবে না বলেই জানিয়েছে। রাজনৈতিক কার্যকলাপ চালিয়ে যাবে। তবে বাস্তবতার বিচারে, আওয়ামী লিগের কামব্যাক করা একটু কঠিন। যদিও একাংশের যুক্তি, কোনও ব্যক্তি বিশেষের বিরুদ্ধে মামলার ভিত্তিতে আওয়ামী লিগকে নিষিদ্ধ করা যায় না। আবার আওয়ামী লিগকে নিষিদ্ধ করায়, জনমানসে কৌতুহল আরও বাড়তে পারে, সেক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের এই সিদ্ধান্ত বুমেরাং হয়েই ফিরে আসতে পারে। এবার কোন দিকে মোড় নেয় বাংলাদেশের রাজনীতি, তাই-ই দেখার
Post A Comment:
0 comments so far,add yours