কে হবেন বাংলাদেশে ইউনূসের উত্তরাধিকারী?
সরাসরি পদত্যাগের কথা না উঠলেও ঘুরপথে ইউনূসকে সরাতে উদ্য়োগী হয়েছে প্রত্যেকেই। যেমন, সম্প্রতি সেদেশের সেনাপ্রধানের ওয়াকার-উজ-জামানের করা মন্তব্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
কে হবেন বাংলাদেশে ইউনূসের উত্তরাধিকারী?
প্রতীকী ছবি
ইউনূসের পর কে? বাংলাদেশের অলিতেগলিতে আপাতত ঘুরে বেড়াচ্ছে এই প্রশ্নটাই। এক কথায় বলা যেতে পারে, পড়শি দেশের রাজনীতি আবার শুরু হয়েছে একটা রগরগে ক্ষমতার নাটক। হাসিনার দেশছাড়ার প্রায় ১ বছরের আগেই নতুন সংকটে বাংলাদেশ। সংকট ক্ষমতার। সংকট নির্বাচনের। সংকট সরকার বনাম সেনার।
নাটকের শুরু
এই নাটকের সূচনা বৃহস্পতিবার সন্ধেয় জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের হাত ধরে হলেও, এর কাহিনী লেখা হয়েছে কয়েক মাস ধরে। সেনা চাপ, রাজনৈতিক চাপ ও আন্তর্জাতিক চাপ। ইউনূসকে সরকারের মাথায় যারা বসিয়েছে, তারাই এখন নামানোর জন্য ব্যবস্থা করছে।
তিন পটে আঁকা ইউনূসের পদত্যাগ পটচিত্র
প্রথম দৃশ্য, বাংলাদেশে তপ্ত রাজনীতিতে তখন মাঝে মধ্য়ে লাগছে ফেব্রুয়ারির ঠান্ডা হাওয়া। কিন্তু তারপরেও শীতল থাকছে না বাংলাদেশ। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পর তৈরি করা অন্তর্বর্তী সরকারের এক দফতরের উপদেষ্টা পদে বসেছিলেন নাহিদ ইসলাম। বলা হয়, হাসিনার সরকারের পতনের মূল চক্রী এই নাহিদ। কিন্তু কয়েক মাস পরেই সেই উপদেষ্টা পদ থেকে ইস্তফা দেন তিনি। অভ্যুত্থানকালের এক সতীর্থের সঙ্গে গড়ে তোলেন নতুন দল। নাম জাতীয় নাগরিক পার্টি।
দ্বিতীয় দৃশ্য, বিএনপি, জামাত ও বাংলাদেশের বাকি সকল রাজনৈতিক দল নামল এক যোগে। আদর্শ আলাদা। কিন্তু উদ্দেশ্য এক। কী সেই উদ্দেশ্যে? চাই জাতীয় নির্বাচন। আর এই দাবিতে সবচেয়ে বেশি সরব হল BNP। কারণটাও খুব স্বাভাবিক NCP এখনও নিজেকে পাকাপোক্ত করতে পারেনি। ওই দিকে আওয়ামী লীগও নেই। ফলত, ক্ষমতা দখলের জন্য এর চেয়ে ভাল সময় আর নেই। বৈঠক, সমাবেশ। প্রথম নরম সুরে, তারপর কথা না শুনলে চড়া সুরে ইউনূস সরকারের বিরুদ্ধে নির্বাচন আয়োজনের দাবিতে নামে তারা।
তৃতীয় দৃশ্য, সেনার সঙ্গে সম্পর্কের রসায়নে গরমিল। প্রথম থেকেই সেনার সঙ্গে খুব একটা ভাল সম্পর্ক ছিল না বাংলাদেশের ইউনূস সরকারের। ওয়াকিবহাল মহল বলছে, দুই পক্ষ সেই সম্পর্ক ভাল করার চেষ্টাও করেনি কখনও। বরং সেনাশাসন তৈরির একটা পূর্ণ চেষ্টা সেদেশে সর্বদা দেখা গিয়েছে। সম্প্রতি, সেনা-সরকারের সংঘর্ষ আরও স্পষ্ট হয়েছে রাখাইন সীমানা ঘিরে।
সেখানে এখন মায়ানমারের জুন্টা সরকার ও আরাকান আর্মির মধ্যে চরম সংঘাত। আর সেই রাখাইন সীমান্তে রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশকে মানবিক করিডর তৈরির আর্জি জানিয়েছে রাষ্ট্রপুঞ্জের জেনারেল সেক্রেটারি আন্তেনিও গুতারেস। যা করতে উদ্যত্ত অন্তর্বর্তী সরকার। কিন্তু আপত্তি তুলছে সেনা ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলি। কারণ, বাংলাদেশ রাখাইন সীমান্তে মানবিক করিডর বানালে চাপ বাড়বে তাদের উপরেই। যেমন এক দিকে আরও বাড়বে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ। অন্যদিকে, জুন্টা সরকার ও আরাকান আর্মির চলা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়বে বাংলাদেশের সেনা। যা এই অবস্থায় কাঙ্খিত নয়, বলে মত একাংশের।
পদত্যাগের দাবি
সরাসরি পদত্যাগের কথা না উঠলেও ঘুরপথে ইউনূসকে সরাতে উদ্য়োগী হয়েছে প্রত্যেকেই। যেমন, সম্প্রতি সেদেশের সেনাপ্রধানের ওয়াকার-উজ-জামানের করা মন্তব্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তাঁর দাবি, ‘দ্রুত জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হোক। পাশাপাশি সামরিক বিষয়ে নাক গলানো বন্ধ করুক ইউনূস সরকার। অন্তর্বর্তী সরকারকে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। এই সরকার গঠনের উদ্দেশ্য ছিল সুষ্ঠভাবে স্বাধীন নির্বাচনের আয়োজন করা।’ সেনাপ্রধানের এই দাবির পর থেকেই চটেছে অন্তর্বর্তী সরকার। সেনা যে ঘুরপথে ইউনূসের সরকার ফেলতে ঘুঁটি সাজাচ্ছে বলে মত অনেকের। অন্তর্বর্তী সরকারের টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারীর দাবি, ‘আজকের দুনিয়ায় কোন সভ্য দেশের সেনাবাহিনী রাজনীতি করে না। পাশাপাশি, এই ক্ষেত্রে তারা নাকও গলায় না। নির্বাচন নিয়ে সেনাপ্রধানের মন্তব্য তাঁর জুরিশডিকশনাল কারেক্টনেস রক্ষা করতে পারেননি। সেনাবাহিনীকে প্রাপ্য সম্মান দেখাতে হবে, আস্থা রাখতে হবে। হটকারিতা চলবে না। ইনক্লুসিভনেসের নাম করে আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনও চাওয়া যাবে না। বাংলাদেশ সেনা আমাদের গর্ব এবং আস্থার জায়গা, সেটা কেউ ভাঙবে, তা কাম্য না।’
প্রধান উপদেষ্টা যে পদত্য়াগ করতে পারেন, সেই কথা বলেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামও। বৃহস্পতিবার সন্ধেয় ইউনূসের যমুনা বাসভবনে গিয়েছিলেন তিনি। সেখানেই তাঁকে এমনটা জানিয়েছেন খোদ প্রধান উপদেষ্টা। ইউনূসের ইস্তফা নিয়ে যখন চড়ছে জল্পনা। সেই আবহে আবার ইউনূসেরই এক আস্থাভাজন তথা জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমানের ইস্তফার দাবিতে সরব হয় বিএনপি। বলে রাখা ভাল, এই খলিলুর রহমান হলেন সেই ব্য়ক্তি যাকে ইউনূস এনেছেন রাখাইন সীমান্তের করিডরের ইস্যু দেখার জন্য, দাবি একাংশের।
নির্বাচন হলে বা সরকার পড়লে বসবে কে?
হাসিনাকে ঘিরে যখন বিতর্ক ও জল্পনার মেঘ তৈরি হয়েছিল বাংলাদেশের আকাশে। সেই সময়ও উঠে এসেছিল একাধিক নাম। কিন্তু প্রতিটাই রাজনৈতিক। তবে পরে রাজনীতি ছেড়ে সামাজিক ভাবে যার ভাবমূর্তি উন্নত এমন এক ব্যক্তিকে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের মাথায় বসায় আন্দোলনকারীরা। এরপর প্রায় ১ বছর কেটে গেলেও, দেশের হাল যে ফেরেনি এই নিয়ে দ্বিমত নেই প্রায় কারওর। এই অবস্থায় যদি সরকার বদল হয় বা আবার অন্তর্বর্তী সরকারের কোনও বিকল্প ভাবা হয় সেক্ষেত্রে কেই বা উত্তরাধিকার হতে পারে?
কারণ, নির্বাচন তো এখনও স্বপ্ন। প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, গতকাল উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে দীর্ঘক্ষণ উপদেষ্টাদের সঙ্গে কথা বলেন মহম্মদ ইউনূস। দেশের সামগ্রিক অবস্থা নিয়ে কথা হয়। বৈঠকে উপস্থিত থাকা একাধিক সূত্রের দাবি, ঢাকায় প্রতিদিন সড়ক আটকে আন্দোলন, সংস্কারসহ বিভিন্ন বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলির ঐকমত না হওয়া, রাষ্ট্রীয় কাজে নানা পক্ষের অসহযোগিতার বিষয়টি তুলে ধরেন এবং কাজ করতে না পারা নিয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করেন। সূত্রের দাবি, বৈঠকে ইউনূস পদত্যাগ করার এবং আরেকটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করার প্রস্তাব দেন। এমনকি, সেই বৈঠকে এই নিয়েও আলোচনা হয় যে বর্তমান পরিস্থিতিতে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে সংশয়পূর্ণ। সূত্রের খবর বৈঠকে ইউনূস বলেছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্বাচন হলে, ব্যালট ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা পুলিশ কতটা আটকাতে পারবে, তা নিয়ে সংশয় আছে।
এই পরিস্থিতিতে নির্বাচন নয়, বরং অন্তর্বর্তী বা ট্রান্সিশনাল সরকারই ভবিষ্যৎ, মত একাংশের। কিন্তু মাথায় বসবে কে? বাংলাদেশের জনপ্রিয় ইউটিউবার তথা অ্যাক্টিভিস্ট তিনি। মাস কয়েক আগে নিজের এক ইউটিউব ভিডিয়োয় তিনি দাবি করেন, বাংলাদেশে ইউনূসের যোগ্য উত্তরসূরী হতে পারেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তথা খালেদা জিয়ার সন্তান।
পিনাকীর কথায়, বাংলাদেশের যুব ও প্রবীণ উভয় প্রজন্মের মধ্য়ে তারেকের চলাফেরা। এমনকি, রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হওয়ায় গ্রহণযোগ্যতাও রয়েছে তাঁর। তবে সে কতটা দক্ষতার সঙ্গে সরকারের নেতৃত্ব সামাল দিতে পারবে, সেই নিয়ে সংশয়ও প্রকাশ করেন এই অ্যাক্টিভিস্ট। তাঁর কথায়, ‘বিএনপি ইতিমধ্যেই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জন্য সমালোচনার মুখে পড়েছে এবং তারা ভারত-সহ আন্তর্জাতিক সমস্যা সামলাতে সক্ষম হবে কিনা, তা এখনও স্পষ্ট নয়।’
এছাড়াও, দেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সামাল দিতে পিনাকীর পরামর্শ, বাংলাদেশে ট্রান্সিশনাল সরকার গঠন করা যেতে পারে। যেখানে বিএনপি, জামায়াত, গণঅধিকার পরিষদ ও অন্যান্য দলগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এই সরকার দেশে রাজনৈতিক স্থিরতা তৈরির মধ্যে দিয়ে রাজনৈতিক সরকার গঠন করতে পারবে।
উল্লেখ্য, বিএনপি সেই পথে হাঁটছে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। তবে জামায়াত নয়, বরং তলে তলে নতুন তৈরি হওয়া জাতীয় নাগরিক পার্টির সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করছে তারেকে দল, এমনটাই দাবি বাংলাদেশের দেশ রূপান্তর সংবাদমাধ্যমে। একটি প্রতিবেদন তারা লিখেছে, বাইরে এনসিপিকে যেমনই দেখা যাক, তলে তলে বিএনপির নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে তারা। কার্যত, বাইরে দূরত্ব ও ভিতরে যোগাযোগ। এই শর্তেই বাংলাদেশে রাজনৈতিক ময়দান তৈরি করছে দুই দল, মত ওয়াকিবহাল মহলের।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours