Abhishek in Bankura: ওন্দার মঞ্চ থেকে অভিষেক কোন বার্তা দিলেন দলীয় কর্মী ও সমর্থকদের? পঞ্চায়েতের আগে কোন ভোকাল টনিক দিলেন নীচুতলায়? অভিষেকের সভার গুরুত্বপূর্ণ বার্তা একনজরে।

Abhishek Banerjee: জাতীয় দলের তকমা হারানোর পর বাঁকুড়ায় অভিষেক, নিশানায় জেলার দুই বিজেপি সাংসদঅভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়
ওন্দা: সদ্য জাতীয় দলের তকমা হারিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস (Trinamool Congress)। সেই নিয়ে বিরোধীদের খোঁচার শেষ নেই। আর এমনই এক পরিস্থিতিতে বাঁকুড়ার ওন্দায় সভা করলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় (Abhishek Banerjee)। জাতীয় দলের তকমা মোছার পর এই প্রথম বড় সভা। ওন্দার মঞ্চ থেকে অভিষেক কোন বার্তা দিলেন দলীয় কর্মী ও সমর্থকদের? পঞ্চায়েতের আগে কোন ভোকাল টনিক দিলেন নীচুতলায়? অভিষেকের সভার গুরুত্বপূর্ণ বার্তা একনজরে।


ভোটেগরম বাংলায় চড়ছে রাজনীতির পারদ। শুধু রাজনীতির পারদই চড়ছে না, আক্ষরিক অর্থেই তেঁতে রয়েছে বাঁকুড়া। চল্লিশ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে পৌঁছে গিয়েছে তাপমাত্রা। অভিষেকের বক্তব্য, এই গরমের মধ্যেও যাঁরা সভায় এসে ভিড় করেন, তাঁরা বক্তব্য শুনতে আসেন না। বললেন, ‘ওই মানুষরা সিদ্ধান্ত নিয়ে এসেছেন, বাঁকুড়ায় এর আগে ২০১৯ সালে ও ২০২১ সালে বিজেপিকে সমর্থন করে যে পাপ বাঁকুড়ার মানুষ করেছে, তার প্রায়শ্চিত্ত আগামী দিনে করবেন তাঁরা। সেই প্রায়শ্চিত্ত করতে একমাত্র বিকল্প তৃণমূল কংগ্রেস ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত শক্ত করতে হবে।’
বাঁকুড়াবাসীর লড়াইয়ের পাশে থাকার বার্তা দিলেন অভিষেক। একইসঙ্গে অতীতের নির্বাচনগুলিতে বাঁকুড়া থেকে বিজেপির ভাল ফলের কথাও স্মরণ করিয়ে দেন তিনি। বললেন, ‘আমাদের সকলকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ২০১৯ সালে আপনারা বিজেপিকে দুটি লোকসভা আসনে জিতিয়েছিলেন। পরবর্তীতে ১২টি বিধানসভা আসনের মধ্যে আটটিতে বিজেপিকে জিতিয়েছিলেন। পরে তন্ময় বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে এলে আমাদের পাঁচজন বিধায়ক হয়। কিন্তু যাঁরা আচ্ছে দিনের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে বলে বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন, কেউ আচ্ছে দিন পেয়েছেন? আপনারা কেন ভোট দিয়েছিলেন বিজেপিকে? আপনারা ভেবেছিলেন মোদীজি ৫৬ ইঞ্চি ছাতির কথা বলেন, তাই হয়ত আগামী দিনে দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী হবে, হয়ত মোদী সরকার গ্রামে গ্রামে কর্মসংস্থান তৈরি করবে, পেট্রোল-ডিজেল-কেরোসিনের দাম কমবে। হয়ত ভেবেছিলেন দিকে দিকে উন্নয়নের জোয়ার বইয়ে দেবে।’
দুই বিজেপি সাংসদ সৌমিত্র খাঁ ও সুভাষ সরকারকে একহাত নিলেন অভিষেক। বললেন, ‘এদের মাটিতে দেখা যায় না। কোভিডের সময় নিজেদের জীবন বিপন্ন করে তৃণমূল দাঁড়িয়েছে আপনাদের পাশে। তৃণমূলকে আপনি নিজের সুখে বা আনন্দে পাননি। কিন্তু দুঃখে ও বিপদে একমাত্র তৃণমূল কংগ্রেসই আছে।’
অতীতে বাম আমলের থেকে বর্তমানে যেভাবে পরিস্থিতির বদল হয়েছে, যেভাবে এলাকায় সুশাসন ফিরে এসেছে, সেই কথাও তুলে ধরেন অভিষেক। বললেন, ‘আগে মানুষের রাস্তায় হাঁটার অধিকার ছিল না। অনেক মহিলা যাঁরা বিয়ের পর প্রথম ৭-১০ বছর বামফ্রন্ট সরকার দেখেছেন, তাঁরা নিজেদের প্রশ্ন করুন। সেই সময়ে দুই হাতে কলসি নিয়ে ১০ কিলোমিটার যেতে হত জলের জন্য। এখন গ্রামে গ্রামে জলের পরিষেবা মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়ের সরকার পৌঁছে দিয়েছে।’

যদিও কিছু কিছু জায়গায় জলের সমস্যার কথা মেনে নেন অভিষেক। বললেন, ‘তিনটি ব্লকে জলের সমস্যা রয়েছে। ওন্দার কিছু জায়গা, বাঁকুড়া ১ ব্লক ও বড়জোড়া ব্লকে সমস্যা রয়েছে।’ যদিও আগামী কয়েকদিনের মধ্যে সেই কাজ শুরু হয়ে যাবে বলে আশ্বাস দিলেন অভিষেক। বললেন, ‘দশ দিনের মধ্যে কাজ শুরু হবে। আগামী এক বছরের মধ্যে বাকুঁড়ার প্রত্যেক গ্রামে নলবাহিত জলের সুব্যবস্থা মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়ের সরকার করবে।’
বিধানসভার ভোটে আটটি আসনে মানুষের রায় তৃণমূলের বিরুদ্ধে গেলেও সেখানকার মানুষ যে উন্নয়ন থেকে পিছিয়ে নেই, সেই কথা ওন্দার সভামঞ্চ থেকে বুঝিয়ে দিলেন অভিষেক। লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, পথশ্রী প্রকল্পের কথাও তুলে আনেন তিনি।
২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বাঁকুড়ার মানুষজন বালাকোট ইস্যুকে সামনে রেখে বহিরাগতদের সমর্থন করেছিলেন বলে দাবি অভিষেকের। বললেন, ‘আপনারা যদি বালাকোটকে সামনে রেখে ভোট দেন, তাহলে আপনি আপনার অধিকার পাবেন না। আপনি মোদীজির ৫৬ ইঞ্চি ছাতিকে সামনে রেখে ভোট দিলে আপনার অধিকার পাবেন না।’
‘বিজেপিকে ভোট দেওয়া আর খাল কেটে কুমীর আনা এক বিষয়’ বললেন অভিষেক।
 ওন্দার সভা থেকে অভিষেক বললেন, ‘আপনাদের নিজদের প্রশ্ন করতে হবে আগামী পঞ্চায়েত ও লোকসভা ভোটে আপনারা কোন বিষয় নিয়ে ভোটে দেবেন। আপনারা রাম মন্দিরের জন্য ভোট দিয়েছিলেন, রামমন্দির হচ্ছে। যদি আপনারা নিজেদের অধিকারের জন্য ভোট দিতেন, তাহলে নিজেদের অধিকারও পেতেন। ইস্যু আপনাদের ঠিক করতে হবে। আগামী ভোট বাংলার অধিকারকে সামনে রেখে হবে। আগামী ভোট ১০০ দিনের টাকা, বাংলার প্রাপ্য, বাংলার আবাস, গ্রাম সড়ক যোজনাকে সামনে রেখে হবে। বাঁকুড়া ও বিষ্ণুপুরকে সামনে রেখে হবে।’
বাঁকুড়ার দুই বিজেপি সাংসদকে ঝাঁঝালো আক্রমণ শানালেন অভিষেক। বললেন, ‘ওন্দায় একটি জায়গা আছে রামসাগর। প্রায় ১৫ হাজার পরিবার মাছ চাষের সঙ্গে যুক্ত। মার্চ-এপ্রিল-মে এই তিন মাস ধরে ডিমপোনার চাষ হয়। এই মাছ চাষীরা ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে মাছ পাঠান। কোভিডের আগে ট্রেনগুলি ওন্দা স্টেশনে দাঁড়াত, কিন্তু এখন আর দাঁড়ায় না। এই জেলার দুইজন সাংসদ, কেউ কি এই ইস্যুটি নিয়ে দাবি-দাওয়া করেছেন?’
একশো দিনের কাজ নিয়ে কেন্দ্রকে আক্রমণ করে অভিষেক বললেন, ‘ প্রায় ২০ লাখ মানুষ কাজ করে বসে রয়েছে, কিন্তু তাঁদের বকেয়া টাকা কেন্দ্র মেটায়নি। এদের কি আপনারা আর ভোট দেবেন? বাংলায় হেরে গিয়ে প্রায় ২০ লাখ মানুষের টাকা গায়ের জোরে আটকে রেখেছে কেন্দ্র। বাংলার মানুষের উপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য এমন করছে।’
একশো দিনের কাজের টাকা নিয়ে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে আরও জোরালো আক্রমণ অভিষেকের। দিল্লিতে গিয়ে আন্দোলনের নামার হুঁশিয়ারি আগেই দিয়েছিলেন তিনি। সেই কথাই এদিন আবারও বললেন, ‘এক কোটি চিঠি নিয়ে আমি কৃষিভবনের বাইরে গিয়ে বসব। দেখব কত ক্ষমতা। দরজা বন্ধ করে, কানে তুলো দিয়ে বসে থাকতে পারলে বসে থাকবে।’
অতীতে বাম জমানায় যে সন্ত্রাসের অভিযোগ তৃণমূল বার বার তুলে এসেছে, সেই প্রসঙ্গে টেনে আনলেন অভিষেক। বললেন, কোতলপুর বিধানসভায় নারায়ণপুর নামে একটি গ্রাম আছে। সেখানে আমাদের একজন অঞ্চল সভাপতি ছিলেন সুভাষ মণ্ডল। ১৯৯৯ সালের ৫ নভেম্বর তাঁকে অপহরণ করে তুলে নিয়ে গিয়েছিল সিপিএম-এর হার্মাদরা। তারপর থেকে ২৪ বছর হয়ে গিয়েছে, আজও সুভাষ মণ্ডলের খোঁজ পাওয়া যায়নি। তাঁর স্ত্রী মঞ্জু মণ্ডল আজও সিঁথিতে সিঁদুর, আর শাখা-পলা পরে রেয়েছেন। আশায় রয়েছেন, তাঁর স্বামী একদিন না একদিন ফিরে আসবেন। যখন তাঁকে অপহরণ করা হয়েছিল, তাঁর ছেলের বয়স ছিল ২ বছর, মেয়ের বয়স ছিল ৪ বছর।’ অভিষেকের দাবি, ১৯৯৮ সালের পঞ্চায়েতে ওই এলাকায় ১৮টি আসনের মধ্যে ১৭টিতেই তৃণমূল জিতেছিল, সেই কারণেই সুভাষ মণ্ডলকে অপহরণ করা হয়েছিল।
আবাস যোজনার কাজে দুর্নীতি ও বেনিয়মের যে অভিযোগ বিজেপি বার বার তুলছে, সেই নিয়েই এদিন পাল্টা দিলেন অভিষেক। সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন জেলার দুই বিজেপি সাংসদের দিকে। বললেন, ‘১১ লাখ ৩৬ হাজার প্রাপকের নাম কেন্দ্রের কাছে পাঠিয়েছে রাজ্য। সৌমিত্র খাঁ ও সুভাষ সরকার যদি এর মধ্যে একজনকেও দেখাতে পারে প্রকৃত প্রাপক নয়, তাহলে আমি আর বাঁকুড়ায় তৃণমূলের জন্য ভোট চাইতে আসব না।’ উল্টে বিজেপির একাধিক কর্মী ও সমর্থকদের নামে আবাসের বাড়ি নিয়ে পাল্টা প্রশ্ন তুলে দিলেন অভিষেক।
অভিষেক বললেন, ‘আমাদের চোখে যদি কারও দুর্নীতি ধরা পড়ে, আমরা তাঁদের ঘাড় ধাক্কা দিয়ে দল থেকে বের করেছি। আর আপনারা (বিজেপি) পুরস্কৃত করে মাথায় তুলে রেখেছেন। আপনাদের সম্পদের নাম সৌমিত্র খাঁ, বালি মামলায় অভিযুক্ত। এসএসসি-তে সুজাতার পরিবারের সদস্যদের ছাড়েনি। সুজাতা আরও ভাল জানে। কিন্তু ওরা যে ভাষায় আক্রমণ করছে, সেই ভাষায় উত্তর দেওয়া আমাদের সংস্কৃতি নয়। তবে সৌজন্যতা তৃণমূলের দুর্বলতা নয়।’
বাঁকুড়াবাসীর উদ্দেশে বললেন, ‘২০১৯ সালে, ২০২১ সালে আপনারা তৃণমূলের থেকে মুখ ফিরিয়েছিলেন। কিন্তু আমরা আপনাদের থেকে মুখ ফেরাইনি। কিন্তু ২০২৩ সালের পঞ্চায়েতে যদি আপনারা নিজেদের অধিকারের স্বার্থে ভোট না দেন, তাহলে আপনাদের অধিকারের জন্য তৃণমূল কংগ্রেস আর রাস্তায় নামবে না। এটা অভিমানী হিসেবে আমিও বলে গেলাম।’
অভিষেক বললেন, ‘যে বিধানসভা এলাকাগুলিতে আমরা জিততে পারিনি, সেখানেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ৫ কোটি টাকা করে খরচ করে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার দিচ্ছেন। আটটি বিধানসভা এলাকা মিলিয়ে ৪০ কোটি টাকা প্রতি মাসে।’
নাম না করে সৌমিত্র খাঁকে কটাক্ষ করে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক বললেন, ‘বাড়ির লক্ষ্মীও রাখতে পারে না। সুজাতাও চলে এসেছে। যে বাড়ির লক্ষ্মীও রাখতে পারে না, সে আবার লক্ষ্মীর ভাণ্ডারকে আক্রমণ করছে।’
অভিষেক বললেন, ‘কোনও নেতা পঞ্চায়েতের প্রার্থী ঠিক করবে না। পঞ্চায়েতের প্রার্থী আপনিই ঠিক করবেন। মানুষ যাকে সার্টিফিকেট দেবে, তাঁকেই তৃণমূল তৈরি করবে প্রার্থী হিসেবে। যাকে মানুষ চাইবে না, তার পাশে তৃণমূল দাঁড়াবে না।’
‘যেখানে বিজেপি নেতাদের দেখতে পাবেন, ঘিরে ফেলুন। বলুন, আগে ১০০ দিনের টাকা ফেরত দিতে হবে, তারপর ভোট চাওয়ার কথা বলবেন। যেখানে দরকার হবে, আমি নিজে যাব আপনার সঙ্গে কথা বলতে। কিন্তু এই আন্দোলনকে সর্বাত্মক করতে হবে।’ বললেন অভিষেক।
একশো দিনের টাকা আটকে দেওয়া প্রসঙ্গে বিজেপিকে খোঁচা দিয়ে বললেন, ‘আপনারা যে রায় দিয়েছেন, সেই রায়ে আপনাদের জব্দ করতে চাইছে।’
Share To:

kakdwip.com

Post A Comment:

0 comments so far,add yours