সারা দেশের সরকারি পরিকাঠামোয় যে চিকিৎসা কার্যত নজিরবিহীন, তা সম্ভব করে দেখাল নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ।

মুম্বইয়ের এক নামী ক্যান্সার হাসপাতাল জবাব দিয়ে দিয়েছিল। বলে দিয়েছিল, আর কোনও আশা নেই। সেই কথা শুনে বছর ছাব্বিশের ছেলেকে নিয়ে ভারাক্রান্ত মনে রাজ্যে ফিরে এসেছিলেন বাবা। বাংলায় ফিরে কার্যত কোনও আশা না রেখেই ছেলেকে নিয়ে গিয়েছিলেন এনআরএস হাসপাতালে (NRS Hospital)। সেখানকার হেমাটোলজি বিভাগের ডাক্তারবাবুদের তত্ত্বাবধানে চলে চিকিৎসা। ক্যান্সার আক্রান্ত সেই যুবককে সুস্থ করে তাক লাগিয়ে দিল এনআরএসের হেমাটোলজি বিভাগ। শুধু তাই নয়, সারা দেশের সরকারি পরিকাঠামোয় কোনওদিন যে চিকিৎসা হয়নি, তা সম্ভব করে দেখাল নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ।



দিয়েছিলেন তাঁর বাবা। কেমোথেরাপি করানো হয়েছিল। কিন্তু তারপরও বার বার ফিরে আসছিল ক্যান্সার। তিন মাস ধরে মুম্বইয়ের এক নামী হাসপাতালে চিকিৎসা চলার পর, সেই হাসপাতাল কার্যত হাত তুলে নিয়েছিল। জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল পিন্টুর মৃত্যু এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। এদিকে ততদিনে প্রায় ১২ লাখ টাকা খরচ হয়ে গিয়েছে পিন্টুর চিকিৎসার জন্য।

এরপর ছেলেকে নিয়ে গতবছরের অক্টোবর মাসে রাজ্যে ফিরে এনআরএসের হেমাটোলজির বহির্বিভাগে যান পিন্টুর বাবা। শেষ সময়ে ছেলে যাতে বিনা চিকিৎসায় মারা না যায়, অন্তত সেটুকু নিশ্চিত করাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। আর এখান থেকেই শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়। পিন্টুকে সুস্থ করে তুলতে হাল না ছাড়া সংগ্রাম চালিয়ে যান হেমাটোলজির বিভাগের চিকিৎসক সন্দীপ সাহা। কিন্তু পিন্টুর অস্থি মজ্জার সঙ্গে ১০০ শতাংশ মিল তাঁর পরিবারের কারও মধ্যে পাওয়া যায়নি। ভাই পিকাই মোহন্তের সঙ্গে ৫০ শতাংশ মিল পাওয়া যায়।

এক্ষেত্রে যে পদ্ধতিতে চিকিৎসা সম্ভব তার নাম `হ্যাপলো আইডেন্টিক্যাল স্টেমসেল ট্রান্সপ্লান্ট’। কী সেই চিকিৎসা পদ্ধতি? এই চিকিৎসা পদ্ধতিতে রোগীকে হেপা-ফিল্টার রুমে রেখে ক্ষতিগ্রস্ত স্টেম সেলগুলিকে বার করা হয়। দেওয়া হয় কড়া মাত্রার কেমোথেরাপি। সংক্রমণের অনুপ্রবেশ রোধে হেপা-ফিল্টারের কক্ষপথে ত্রিস্তরীয় বলয় থাকে। হেমাটোলজি বিভাগের চিকিৎসক সন্দীপ সাহা বলছেন, “প্রথম পর্যায়ে চেষ্টা করা হয়, যাতে ক্ষতিগ্রস্ত বোন ম্যারোকে কেমোথেরাপি ও রেডিয়োথেরাপি দিয়ে বার করে দেওয়া হয়। এরপর অর্ধেক মিলের স্টেম সেলকে রোগীর দেহে ধীরে ধীরে দেওয়া হয়। সেটিই তারপর ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে এবং রোগীর সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা বাড়তে থাকে।”

হ্যাপলো ট্রান্সপ্ল্যান্ট পদ্ধতির পাশাপাশি রোগগ্রস্ত অস্থিমজ্জার পুরোপুরি অপসারণে জরুরি ছিল বিশেষ ধরনের রেডিয়েশন। যার নাম `টোটাল বডি ইররেডিয়েশন’ বা টিবিআই। সরকারি পরিকাঠামোয় টিবিআই-এরও নজির নেই বললেই চলে। স্বাভাবিক ভাবে রেডিওথেরাপি বিভাগের সম্মতি আদায়ে ফের একবার হাল না ছাড়ার অঙ্গীকার করেন চিকিৎসক সন্দীপ সাহা। তাঁর অনুরোধে সাড়া দিয়ে ছাব্বিশ বছরের যুবককে বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন রেডিওথেরাপি বিভাগের প্রধান শ্রীকৃষ্ণ মণ্ডলও।

রোগগ্রস্ত অস্থিমজ্জার অপসারণের পরে স্টেম সেল প্রক্রিয়ায় রোগীর দেহে ভাল অস্থি মজ্জা প্রতিস্থাপিত করার চিকিৎসা পদ্ধতির নাম হল টোটাল বডি ইররেডিয়েশন। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, সারা দেশে সরকারি পরিকাঠামোয় এ ধরনের খরচ সাপেক্ষ চিকিৎসার নজির নেই। এ দেশে হাতে গোনা কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালে এই চিকিৎসার পরিকাঠামো রয়েছে। খরচ ৪০-৫০ লক্ষ টাকা। সেখানে এনআরএসে এই আধুনিক পদ্ধতিতে রোগীর খরচ হয়েছে মাত্র তিন লক্ষ টাকা।

চিকিৎসক সন্দীপ সাহা বলছেন, বাঙালি হিসেবে এই সাফল্যে তিনি খুবই আনন্দিত। এনআরএস-এর হেমাটোলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান তুফানকান্তি দলুই বলছেন, “আমরা ঝুঁকি নিয়ে সরকারি হাসপাতালে হ্যাপলো আইডেন্টিক্যাল স্টেমসেল ট্রান্সপ্লান্ট করতে পেরেছি। দুরারোগ্য ব্যাধি মানে যে দক্ষিণে বা মুম্বইয়ে শেষ চিকিৎসা, তা একদমই নয়। আমাদের পশ্চিমবঙ্গেও যথেষ্ট ভাল ডাক্তারবাবুরা রয়েছেন, যাঁরা ভারত সেরা।”


Share To:

kakdwip.com

Post A Comment:

0 comments so far,add yours