ইউক্রেনে দখলীকৃত মারিউপোলে খাদ্য সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করেছে। মিডিয়াকে এ তথ্য জানিয়েছেন ইউক্রেনের এমপি দমিত্র গুরিন। পাশাপাশি তিনি পশ্চিমা দেশগুলোর উদ্দেশ্যে বলেছেন, মেনে নিন এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। তিনি আরও বলেছেন, তাদের হাতে মাত্র তিন দিনের খাদ্য মজুদ আছে।এরপরেই ওই শহরের মানুষজনকে অনাহারে থাকতে হবে। দমিত্র গুরিনের পিতামাতা বসবাস করেন মারিউপোলে। তাকে মেয়রের অফিস থেকে বলা হয়েছে, এই বন্দর নগরীর রাস্তায় লাইন দিয়ে পড়ে আছে মৃতদেহ। বোমা হামলায় যে পরিমাণ মানুষ নিহত হয়েছেন বা হচ্ছেন, তাদেরকে সমাহিত করার আর স্থান সংকুলান হচ্ছে না সমাধিক্ষেত্রে। এছাড়াও গম, ভুট্টা, চিনি, লবণ, মাংসসহ প্রধান কৃষিপণ্য রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছে ইউক্রেন সরকার। দেশটির মন্ত্রিসভায় মঙ্গলবার এ সংক্রান্ত একটি আইন পাশ হয়েছে।

নতুন আইন অনুযায়ী, ইউক্রেন থেকে ওটস, বাজরা, চিনি, লবণ, গম, মাংস, গবাদিপশু এবং এ থেকে তৈরিকৃত পণ্য এখন থেকে রপ্তানি নিষিদ্ধ। মন্ত্রিপরিষদের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এটি আসলে একটি রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা। ইউক্রেনের কৃষি নীতি ও খাদ্যমন্ত্রী রোমান লেশচেঙ্কো বলেছেন, ইউক্রেনে মানবিক সংকট প্রতিরোধ, বাজার স্থিতিশীল রাখা এবং জনগণের চাহিদা মেটাতে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ইউরোপের অন্যতম বৃহত্তম কৃষি পণ্য সরবরাহকারী দেশ ইউক্রেন। কৃষি তথ্য বিশ্লেষণ সংস্থা গ্রো ইন্টেলিজেন্সের তথ্য অনুযায়ী, রাশিয়া এবং ইউক্রেন বিশ্বব্যাপী প্রায় ৩০ শতাংশ গম রপ্তানি করে। রাশিয়া ও ইউক্রেন একসময় 'ইউরোপের রুটির ঝুড়ি' আখ্যা পেয়েছিল। বিশ্বের প্রায় এক-চতুর্থাংশ গম ও অর্ধেক সূর্যমুখীজাত পণ্য রপ্তানি করে এই দুই দেশ। আর ইউক্রেন প্রচুর ভুট্টা রপ্তানি করে।

বিশ্লেষকেরা সতর্ক করেছেন, যুদ্ধের ফলে শস্য উত্‍পাদন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী গমের দাম দ্বিগুণ হতে পারে। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির প্রধান ডেভিড বিসলে বলেছেন, বিশ্ব সম্প্রদায়ের শঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। ইউক্রেন সংকটের জেরে বিশ্বব্যাপী খাদ্যমূল্য আকাশ ছুঁতে পারে। অবস্থাপন্ন মানুষের জন্য তা বিশেষ উদ্বেগের না হলেও দরিদ্র মানুষের জীবনে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। সমস্যা হচ্ছে বিবদমান দুই দেশ, অর্থাত্‍ ইউক্রেন ও রাশিয়া উভয়ই মৌলিক খাদ্যসামগ্রী রপ্তানিকারক। যুদ্ধের কারণে স্বাভাবিকভাবেই খাদ্য রপ্তানিতে প্রভাব পড়েছে। ইতিমধ্যে ফসল উত্‍পাদন ব্যাহত হতে শুরু করেছে, বেড়েছে দাম।

তিনি বলেন, যেসব দেশ কৃষ্ণসাগর অঞ্চল থেকে শস্যের বড় অংশ আমদানি করে, চলমান সংকটের প্রভাব তাদের ওপরই বেশি পড়বে। এ প্রসঙ্গে লেবাননের কথা উল্লেখ করেন তিনি। দেশটি যত খাদ্যশস্য আমদানি করে, তার অর্ধেকই ইউক্রেন থেকে। এই তালিকায় আরও আছে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইয়েমেন, সিরিয়া ও তিউনিসিয়া। এ তালিকা আরও দীর্ঘ করা সম্ভব। যুদ্ধবিধ্বস্ত ইয়েমেন ও সিরিয়া এখন খাদ্য আমদানি করতে না পারলে নতুন করে বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।এদিকে বাংলাদেশে গমের চাহিদার একটি বড় অংশ পূরণ করা হয় রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে আমদানি করে। রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালানোর পর এ দুই উত্‍স থেকেই গম আমদানি নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে ২০২০-২১ অর্থবছরে ৮০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হয়, যার মধ্যে বেশির ভাগই ছিল গম। এ ছাড়া মটর ডাল, সরিষা, পুরোনো লোহার টুকরা, সয়াবিন দানা ও রাসায়নিক আমদানি হয় দেশটি থেকে। চলতি অর্থবছরে (২০২১-২২) চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ৫৪ লাখ ৫৫ হাজার টন গম আমদানি হয়।
এদিকে, রাশিয়ার-ইউক্রেন যুদ্ধের ১৫ দিন আজ। রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী ও দেশবাসী। এর মধ্যে দেশের কিছু অংশে রাশিয়ার সেনাদের এগিয়ে যাওয়ার গতি কমে এসেছে বলে জানিয়েছে ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীর জেনারেল স্টাফ। বৃহস্পতিবার সকালে হালনাগাদ তথ্যে দেশটির সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে জানানো হয়। ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীর জেনারেল স্টাফ জানায়, দেশের কিছু অংশে রাশিয়ার সেনাদের এগিয়ে যাওয়ার গতি কমে এসেছে।

অপরদিকে, ইউক্রেনের পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রী দিমিত্র কুলেবা তুরস্কের শহর আন্তালায়ায় রাশিয়ার সাথে শান্তি আলোচনার জন্য পৌঁছেছেন। তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত চাভোসোগলুর আহ্বানে বৃহস্পতিবার শান্তি আলোচনায় অংশ নিতে আন্তালায়া শহরে পৌঁছান কুলেবা। এর আগে বুধবার রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সার্গেই লাভরভকেও তুরস্কে প্রবেশ করতে দেখা যায়। দুই সপ্তাহ আগে ইউক্রেনে রাশিয়া অভিযান শুরু করার পর এই প্রথম তিন পক্ষের কূটনীতিকদের মধ্যে বৈঠক হতে যাচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রে বিবিসি এর সহযোগী সিবিএস নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাত্‍কারে মার্কিন কর্মকর্তারা ধারণা প্রকাশ করেছেন যে যুদ্ধের প্রথম দুই সপ্তাহে পাঁচ থেকে ছয় হাজার রুশ সৈন্য মারা গেছে। সাধারণ হিসেবে মৃত্যুর সংখ্যার তিনগুণ সংখ্যক মানুষ আহত হয়ে থাকে-এমন একটি ধারণা থেকে বলা হচ্ছে যে অন্তত ১৫ থেকে ১৮ হাজার রুশ সেনা আহত হয়েছেন। ইউক্রেন দাবি করেছে যে, যুদ্ধে ১২ হাজার রুশ সৈন্য মারা গেছেন। গত সপ্তাহে রাশিয়া জানিয়েছিল যে ইউক্রেনে তাদের পাঁচশোরও কম সৈন্য মারা গেছে।

সূত্র জানায়, ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধে ৫ হাজার থেকে ৬ হাজার রুশ সেনা প্রাণ হারিয়েছে বলে জানিয়েছেন এক মার্কিন কর্মকর্তা। কয়েক দিন আগে ধারণা করা হয়েছিল রুশ সেনা নিহতের সংখ্যা তিন হাজারের আশেপাশে। তবে দ্রুত সে সংখ্যা বেড়েছে। ফলে ধারণা করা হচ্ছে, ইউক্রেনের শহরগুলোতে ভয়াবহ যুদ্ধ চলছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা রুশ সেনাদের মৃত্যুর এই হারকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করেন। মার্কিন গণমাধ্যম সিবিএজ নিউজকে তিনি বলেন, এ যুদ্ধে প্রায় ১৫ হাজার থেকে ১৮ হাজার রুশ সেনা আহত হয়েছে বলে ধারণা করছেন তিনি। তবে এ বিষয়ে তিনি নিশ্চিত নন। সাধারণত যুদ্ধে আহতের সংখ্যা নিহতের তিন গুন হয়, সেই অংক কষেই আহত রুশ সেনাদের সংখ্যার ধারণা করেছেন তিনি।
যদিও ওই মার্কিন কর্মকর্তা আরও বলেছেন যে, এই ভয়াবহ ক্ষতির পরেও রাশিয়ান সেনারা এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে কিয়েভকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলতে পারবে।সম্প্রতি ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, তাদের সঙ্গে লড়াইয়ে এখন পর্যন্ত রাশিয়ার ১২ হাজার সেনা নিহত হয়েছেন। যদিও ইউক্রেনে অভিযান শুরুর পর গত সপ্তাহে রাশিয়া প্রথমবার জানায়, ইউক্রেনে তাদের ৪৯৮ জন সেনা নিহত হয়েছেন। তবে আহত সেনার সংখ্যা জানায়নি। রুশদের পাশাপাশি ইউক্রেনেরও কয়েক হাজার সামরিক ও বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ওই মার্কিন কর্মকর্তা জানান, ইউক্রেনের ২ হাজার থেকে ৪ হাজার সেনা নিহত হয়েছে এই যুদ্ধে। গত ৯ দিন ধরে মারিউপোল শহর ঘিরে রেখেছে রুশ সেনারা। সেখানে প্রায় ১২০০ মানুষ নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কির কার্যালয়। এখন পর্যন্ত ১৮ হাসপাতাল কিংবা এ্যাম্বুলেন্স রুশ হামলায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এসব হামলায় অন্তত ১০ নিহত ও ১৬ জন আহত হয়েছেন।
তবে রাশিয়ার ভয়াবহ হামলা সত্বেও ইউক্রেনের শহরগুলো প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। কয়েক দফা যুদ্ধবিরতির কারণে হাজার হাজার বেসামরিক মানুষ শহরগুলো ত্যাগ করার সুযোগ পেয়েছে। তারপরেও যারা ভেতরে আটকা পড়েছেন তারা খাদ্য, পানি ও ওষুধের মতো প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির সংকটে ভুগছেন।এদিকে দখলীকৃত মারিউপোলে খাদ্য সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করেছে। মিডিয়াকে এ তথ্য জানিয়েছেন ইউক্রেনের এমপি দমিত্র গুরিন। পাশাপাশি তিনি পশ্চিমা দেশগুলোর উদ্দেশে বলেছেন, মেনে নিন এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ।

তিনি আরও বলেছেন, তাদের হাতে মাত্র তিন দিনের খাদ্য মজুদ আছে। এরপরেই ওই শহরের মানুষজনকে অনাহারে থাকতে হবে। দমিত্র গুরিনের পিতামাতা বসবাস করেন মারিউপোলে। তাকে মেয়রের অফিস থেকে বলা হয়েছে, এই বন্দর নগরীর রাস্তায় লাইন দিয়ে পড়ে আছে মৃতদেহ। বোমা হামলায় যে পরিমাণ মানুষ নিহত হয়েছেন বা হচ্ছেন, তাদেরকে সমাহিত করার আর স্থান সংকুলান হচ্ছে না সমাধিক্ষেত্রে।
ফলে স্থানীয় প্রশাসন এক একটি গণকবরে ৩৩ টি পর্যন্ত মৃতদেহ দাফন করছেন। দমিত্র গুরিন বলেছেন, বর্তমানে আমরা এমন এক পরিস্থিতিতে আছি, যেখানে বেসামরিক মানুষজন আর শান্তিপূর্ণ শহরে কার্পেট বোমা হামলা চালানো হয়েছে। মারিউপোলের দক্ষিণে বসবাস করেন আমার পিতামাতা। ওই এলাকায় কখনোই কোনো সামরিক স্থাপনা ছিল না। তা সত্ত্বেও সেখানে ভয়াবহ বোমা হামলা চালিয়ে যাচ্ছে রাশিয়া।

তিনি পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, স্বীকার করুন এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি তিনি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, দয়া করে পুরনো মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান দিয়ে ইউক্রেনের বিমানবাহিনীকে সহায়তার জন্য পোল্যান্ডকে অনুমোদন দিন। আর কত ইউক্রেনিয়ান মারা গেলে, এক সপ্তাহে আর কত মানুষ মারা গেলে- এই সহায়তা পাওয়া যাবে। এ বিষয়টি বেছে নেয়ার কথা গ্রেট বৃটেন স্মরণ করতে পারে ৮০ বছর আগে। আমরা মনে করি এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটা শুধু আমাদের জন্য নয়। এই সহায়তা প্রয়োজন আপনার জন্য এবং আপনাদের ভবিষ্যতের জন্যও।
Share To:

kakdwip.com

Post A Comment:

0 comments so far,add yours