ইসরো সূত্রে জানা গিয়েছে, বেশ কয়েকটি বিষয় নিয়ে গবেষণা করবে শুভাংশুর দল। গ্রুপ ক্যাপ্টেন হিসাবে অন্যান্য দেশের বিজ্ঞানী তথা নভশ্চরদের শুধু পৌঁছে দেওয়াই তার কাজ ছিল না।

 শুভাংশকে পাঠিয়ে ভারতের কী লাভ? জানুন


ভারতীয় সময় অনুযায়ী বুধবার বেলা ১২টা বেজে ১ মিনিট। আমেরিকার আকাশে তখন বিন্দু মাত্র আলো নেই। ঘুটঘুটে অন্ধকার। যে টুকু আলোকছটা তা সবই কৃত্রিম, যান্ত্রিক। দূরে আকাশে দেখা যাচ্ছে ছোট চাঁদটা। হাতের ঘড়ি দেখে সময় মাপছেন কয়েক জন নভশ্চর। কারণ, আর কিছুক্ষণেই অভ্রভেদী হবেন তাঁরা। পৌঁছে যাবে আকাশে। মহাকাশে। তাদের হয় তো মাটি থেকে আমরা আর দেখতে পারব না। কিন্তু জানব এই শূন্যতার ঠিক কোথাও না কোথাও বিন্দুর মতো একটা জায়গা দখল করে রয়েছে তাঁরা। কথা হচ্ছে ‘ঘরের ছেলে’ শুভাংশু ও তাঁর অন্য সতীর্থদের মহাকাশ যাত্রা নিয়ে।


দীর্ঘ টালবাহানার পর শুভাংশু শুক্লা-সহ চার অভিযাত্রীকে নিয়ে মহাকাশে পাড়ি দিয়েছে স্পেসএক্সের ‘ড্রাগনযান’। আমেরিকার ফ্লরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে আকাশের দিকে ছুটে যায় ফ্যালকন ৯ রকেট। অভিযানের নাম দেওয়া হয়েছে ‘অ্যাক্সিয়ম-৪’। নাসা ও ইসরোর যৌথ উদ্যোগে এই অভিযান হওয়ার কথা ছিল গত ২৯ মে। কিন্তু সময় যে এখনও সর্বপরি। সেই তো দেবে বিধান। সেই সময়ের টানাপোড়েনেই মোট সাত বার যাত্রা পিছিয়ে যাওয়ার পর তা সফল হয় চলতি সপ্তাহের বুধবার। এরপর প্রায় ২৪ ঘণ্টার ব্যবধান।বৃহস্পতিবার ভারতীয় সময় অনুযায়ী বিকাল ৪টা ০২ মিনিট নাগাদ আন্তর্জাতিক মহাকাশ ঘাঁটিতে পৌঁছে যায় শুভাংশুদের রকেট। সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ সম্পন্ন হয় ডকিং। ভেসে ভেসে প্রথম ভারতীয় হিসাবে ISS-এ ঢুকে পড়েন শুভাংশু। কোন উদ্দেশ্যে মহাকাশ ঘাঁটিতে পা দিয়েছেন শুভাংশুরা?



সম্ভবত ১৪ দিন পর্যন্ত চলবে এই অভিযান। তারপর আবার পৃথিবীতে ফিরবেন শুভাংশুরা। এর মাঝে তাদের গবেষণার বিষয়বস্তু রয়েছে অনেকগুলোই। তবে তার মধ্যে শীর্ষ স্থানীয় হচ্ছে, ফসল ফলন। একদম ঠিক শুনছেন। মহাকাশে হবে ফসল ফলানো। আর সেই পথটা খুঁজতে আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্রে পাড়ি দিয়েছেন শুভাংশুরা।

জানা গিয়েছে, ছয় ধরনের চারা নিয়ে গিয়েছে তারা। সেই চারা বীজগুলি দিয়েই মহাকাশে দিনের পর দিন চলবে পরীক্ষানিরিক্ষা। কীভাবে মহাশূন্যের বুকে মানুষ গাছের জন্ম দিতে পারে, সেই বিষয়টাই খতিয়ে দেখা হবে। এছাড়াও, গাছের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন হয় সালোকসংশ্লেষের। সেই কথাটা মাথায় রেখেই নিজেদের সঙ্গে পৃথিবী থেকে সায়ানো ব্যাকটেরিয়া নিয়ে গিয়েছেন শুভাংশুরা। এই ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি সালোকসংশ্লেষে সাহায্য করে থাকে।

সুনীতা উইলিয়ামস যখন কয়েক মাস মহাকাশে কাটিয়ে পৃথিবীতে ফিরেছিলেন, তখন দেখা গিয়েছিল যে তিনি হাঁটতে, চলতে পারছেন না।স্ট্রেচারে চাপিয়ে তাঁকে ও তাঁর সতীর্থকে নিয়ে যাচ্ছেন নাসার বিজ্ঞানী ও অন্যান্য কর্মীরা। আর এটা শুধু সুনীতা বলেই নয়। মহাশূন্যে গিয়ে নানা শারীরিক সমস্যায় পড়তে হয় নভশ্চরদের। অতল অন্ধকারে পৌঁছে শুভাংশুও যে অসুস্থবোধ করেছিলেন, তা তিনি নিজেই জানিয়েছিলেন।

শুভাংশু বলেন, ‘আমি এখনও জিরো গ্রাভিটির সঙ্গে অভ্যস্ত হচ্ছি। ঠিক যেমন এক শিশু হাঁটতে শেখে। শিখছি কীভাবে চলাফেরা করতে হয়, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। তবে আমি প্রতিটা মুহূর্ত উপভোগ করছি। অনেক ঘুমাচ্ছি। তবে শরীরে কিছুটা অস্বস্তিও হচ্ছে।’ আসলে এটাই স্বাভাবিক। অনেক সময় এও দেখা গিয়েছে, মহাশূন্যে থেকে পৃথিবীতে ফিরে হাড়ে ক্যান্সার হওয়ার মতো ভয়াবহ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন নভশ্চররা। অ্যাক্সিয়ম-৪ অভিযানে সেই নিয়েও চলবে গবেষণা। কীভাবে মহাশূন্যে পেশি ও হাড়কে সচল ও সতেজ রাখা যায় তা খতিয়ে দেখবেন বিজ্ঞানীরা।

ভারতের কী লাভ?

বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা গিয়েছে, শুভাংশুকে মহাকাশে পাঠানো থেকে পৃথিবীতে ফেরানো পর্যন্ত মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করে ফেলেছে ভারতের মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র ইসরো, ঘুরপথে কেন্দ্রীয় সরকার। এখনও পর্যন্ত পাওয়া হিসাব অনুযায়ী, এই গোটা অভিযানে ভারতের গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪১৩ কোটি টাকা ঢেলেছিল। নতুন অর্থবর্ষ শুরু হতে আরও ১৩৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছিল। অর্থাৎ সব মিলিয়ে ৫৪৮ কোটি টাকা।

এই বিপুল অর্থ ব্যয়ের মধ্যে দিয়ে আদৌ লাভ হবে ভারতের? নাকি শুধু ইতিহাসের পাতায় নামটাই রয়ে যাবে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই অভিযানে বিনিয়োগ ভারতকে অনেকটা সুবিধা করে দেবে। এক সময় মহাকাশ অভিযান ‘এলিট’ বা অভিজাত দেশ হওয়ার প্রতীক ছিল। যা ভেঙেছে ভারত। পশ্চিমী ‘সাম্রাজ্যবাদী’ ভাবনাকে এই দেশ বুঝিয়েছে অভিজাত নয়, বিজ্ঞান মনস্কতাই কোনও দেশকে টেনে নিয়ে যেতে পারে মহাকাশের দিকে।

রাকেশ শর্মার পর এই প্রথমবার প্রায় ৪১ বছরের ব্যবধানে কোনও ভারতীয় মহাকাশে পাড়ি দিলেন। ২০২২ সাল থেকেই মহাকাশে নভশ্চর পাঠানোর চেষ্টা চালাচ্ছে ইসরো। সেই সূত্র ধরেই সব ঠিক থাকলে ২০২৭ সালের মধ্যেই আকাশের দিকে রওনা দেবে গগনযান। মহাকাশে ভারতের প্রথম নিজস্ব মানব অভিযান। যে কাজে সাহায্য করতে পারবে অ্যাক্সিয়ম-৪ অভিযানের গ্রুপ ক্যাপ্টেন শুভাংশু শুক্লা। তাঁর অভিজ্ঞতাই আরও একাধিক পথ খুলে দিতে পারবে ইসরোর জন্য।

এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভাল, গগনযান কিন্তু কোনও গ্রহের দিকে যাবে না। এটি মহাকাশে ভারতের প্রথম মানব অভিযান। যা যাবে মহাশূন্যের লিও বা লো-আর্থ অরবিট পর্যন্ত। এই লো আর্থ অরবিট বা মহাকাশের নিম্ন কক্ষে সাধারণ ভাবে কৃত্রিম উপগ্রহ মোতায়েন করা থাকে।

শুভাংশুর মহাকাশের যাওয়া ভারতের জন্য একাধিক গবেষণা ও অভিযানের পথ খুলে দিচ্ছে। তাঁর ফিরে আসার পর গগনযান সফল হলে, চাঁদের পথে রওনা দেওয়ার চেষ্টা করবে ইসরো। আর এই কথা তারা আগেই ঘোষণা করেছে। ভারতের এই মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র ঘোষণা করেছে, ২০৪০ সালে মধ্যে তারা চাঁদে নভশ্চর পাঠাবে। এমনকি, নিজেদের স্পেস স্টেশনও তৈরি করবে।

বর্তমানে মহাশূন্য একটিই স্পেস স্টেশন বা আন্তর্জাতিক মহাকাশ ঘাঁটি রয়েছে। ২৫ বছর আগে আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র ‘নাসা’, রাশিয়ার ‘রসকসমোস’, ইউরোপের ‘ইএসএ’, জাপানের ‘জাক্সা’ ও কানাডার ‘সিএসএ’ মিলে যৌথ উদ্যোগে এই মহাকাশ ঘাঁটিটি তৈরি করে। মহাকাশে সমস্ত গবেষণা চলে এখান থেকেই। সারা বছর নাসার কোনও না কোনও গবেষক এই মহাকাশ কেন্দ্রে থাকেন। ভারতের এখানে কোনও প্রতিনিধি নেই। শুভাংশুই প্রথম যে কিনা সেখানে পা রাখলেন। তাও কয়েক দিনের জন্য।

সুতরাং বলা যেতে পারে, ইসরো নিজেদের যে মহাকাশ ঘাঁটি তৈরির পরিকল্পনা করছে, তাতে শুভাংশুর অভিজ্ঞতা বাড়তি সুবিধাই দেবে। সে যেভাবে একটি আন্তর্জাতিক মহাকাশ ঘাঁটিকে নিজের চোখে কাজ করতে দেখছে, সেই অভিজ্ঞতা এখনও কোনও ভারতীয়রই ‘চেখে দেখার’ সুযোগ হয়নি। অতএব, ভারতীয় নিজস্ব মহাকাশ ঘাঁটি তৈরি হলে তাতে শুভাংশুর অভিজ্ঞতা যুক্ত করবে বাড়তি দীপ্তি।

তবে এত গেল বৈজ্ঞানিক বিষয়াদি। মহাকাশ ঘিরে একটি অদ্ভূত ব্যবসাও শুরু হয়েছে এই বিশ্বে। যা আপাতত অতিধনীদের জন্য। সেই ব্যবসাকে বলা হচ্ছে মহাকাশ পর্যটন বা স্পেস ট্যুরিজম।

কী হয় তাতে?

একটা রকেট। যাতে চেপে রয়েছেন একজন চালক ও বাকি তিন-চার জন পর্যটক। তারা কোথায় যাবেন? তারা যাবেন মহাকাশে। শূন্য থেকে এই পৃথিবী কেমন দেখতে বা শূন্য়তা ঠিক কী রকম, সেই অভিজ্ঞতা পেতেই লক্ষ টাকা খরচ করে তারা উঠে পড়েছেন সেই নির্দিষ্ট সংস্থার রকেটে। ইতিমধ্যে আমেরিকার বুকে জনপ্রিয়তা বাড়ছে মহাকাশ পর্যটনের। ঠিক যেমন ভাবে সমুদ্রের অতল গভীরে পর্যটন ব্যবসা খুলেছে ‘টাইটান’। ঠিক তেমন মহাকাশেও পর্যটন ব্যবসা খুলেছে ইলন মাস্কের স্পেসএক্স, ব্যবসায়ী তথা জনপ্রিয় সাইট অ্যামাজনের কর্তা জেফ বেজস। একটা ভারী অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে মহাকাশ ঘোরাচ্ছে তাঁরা। শূন্যের নিম্ন কক্ষ বা লো আর্থ অরবিট পর্যন্ত পর্যটকদের রকেট চাপিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এই সংস্থাগুলি। ইতিমধ্য়েই বেশ কয়েকটি অভিযান সফল হয়েছে। কিন্তু ভারতে কি এই ব্যবসার সম্ভবনা রয়েছে? আসন্ন ভবিষ্যতে হয় তো না। কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে সম্ভবত। ব্যবসায়ীক মুনাফা নয়। বরং মানুষের হাতের মুঠোয় মহাকাশ টেনে আনা হোক এই পর্যটনের উদ্দেশ্য। যার ভিত্তিপ্রস্তর করছেন শুভাংশু।
Share To:

kakdwip.com

Post A Comment:

0 comments so far,add yours