মানবিক চোখে ঘোর লেগে থাকে স্বপ্নের। শিশুর মতো অপারবিস্ময়ে মাখামাখি। বিশ্ব ফুটবলের মিলন মেলায় দাঁড়িয়ে ঈশ্বরকে খুঁজছে আয়োজক কাতার। এই ঈশ্বরই এখন উপাসক। এই ঈশ্বরই এখন ভরসা।

আলোয় মাখামাখি এক টুকরো রাত হাতছানি দিচ্ছে। ধন্দ লেগে যাচ্ছে এলইডির কারুকাজ দেখে। টাইম স্কোয়্যার চলে আসিনি তো! পথ চলতে চলতে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ছে পৃথিবী। সিআর সেভেনের সাইডভলি দেখে। এলএম টেনের ড্রিবল দেখে। ধাঁধা কাটলে বুঝতে পারবেন, মাঠ নয়, আস্ত স্ক্রিন হয়ে গিয়েছে অন্ধকার আকাশ। লেজার শো-র ছটায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে থমকে যাচ্ছে অগুনতি মানুষ। সি-লাইন, কর্নিশ, শুক ওয়াকিফ, আল ওয়াকরা— সন্ধে গড়ালেই মোহময়ী রূপ। যেন রূপকথার পসরা সাজিয়ে বসেছে তামাম দেশ। আর এই রাতই যেন বলে দেয়, যতটা ভাবছেন, কাতার (Qatar) ততটাও ছোট নয়!

আপাদমস্তক সাদা পোশাকে ঢাকা লোকজন হামেশাই নজরে পড়ছে। গনগনে দুপুরে এমন পোশাক চোখের আরাম যেন। কাতারিরা এই রকম পোশাকেই অভ্যস্ত। শুধু কাতার কেন, সারা আরব দেশ জুড়ে শ্বেতশুভ্র কামিজে এই শরীর ঢাকা পোশাকের চল। যার নাম থোব। আট থেকে আশি এমন থোব পরা কেউ পাশ দিয়ে চলে যাওয়ার সময় দু-এক টুকরো শব্দ উপহার দিয়ে যাবে আপনাকে। মারহাবা, আহলানবিক, ক্যফা হালাক, মাসালমা! একটু আরবি জানলেই বুঝতে পারবেন, কাতারিরা আপনার হালহকিকতের খোঁজ নিচ্ছে বিশ্বকাপ (Qatar World Cup 2022) আয়োজনের শত ব্যস্ততার মধ্যেও। যে কোনও দেশ আসলে ঠিকানা। শহর হল তার মুখ। দোহার আনাচে কানাচে, অন্তরমহলে ডুব দিলে নির্মম বালিয়াড়ি মিলবে না। পাওয়া যাবে তুলতুলে নরম হৃদয়। ছোট পাড়ার মতো আন্তরিক। মফঃস্বলের মতো সহৃদয়। বিশ্বকাপের মতো বিরল ইভেন্টের চৌহদ্দিতে দাঁড়িয়ে অন্য কোন দেশ কি এমন হতে পারত?

মানবিক চোখে ঘোর লেগে থাকে স্বপ্নের। শিশুর মতো অপারবিস্ময়ে মাখামাখি। বিশ্ব ফুটবলের মিলন মেলায় দাঁড়িয়ে ঈশ্বরকে খুঁজছে আয়োজক কাতার। এই ঈশ্বরই এখন উপাসক। এই ঈশ্বরই এখন ভরসা। যদি বা চলতে শুরু করে, তিনি একাই সুপারহিট করে দেবেন বিতর্কে জেরবার কাতার বিশ্বকাপকে। কে ইনি? লিওনেল আন্দ্রেস মেসি। কেরিয়ারের শেষ বিশ্বকাপ খেলতে চলেছেন ৩৫ বছরের আর্জেন্টেনিয়ান। এক দশক ধরে ক্লাব ফুটবলে যিনি সবচেয়ে উঁচু আসনে প্রতিষ্ঠিত। দেশের হয়ে কোপা জিতেছেন। কিন্তু বিশ্বকাপ? ফুটবলের রাজপুত্র দিয়েগো মারাদোনা এখনও কয়েক আলোকবর্ষ এগিয়ে। দেশের জার্সি চিরতরে তুলে রাখার আগে মেসি কি ভক্তদের আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ হবেন না? শেষবারের জন্য?

ফুটবল ঈশ্বর মেসির ঠিকানা এখন কাতার

হামিদের বয়স খুব বেশি ১৩। ঝাঁকড়া চুলের ছটফটে কিশোর ভিলাজিও মলে তোলপাড় চালিয়ে মাপ মতো একটা নীল-সাদা জার্সি খুঁজে পেয়ে বেজায় খুশি। ওই জার্সিই একমাস গায়ে থাকবে হামিদের। শুধু হামিদ কেন, কর্নিশে ফিফার মার্চেন্ডাইজ় শপেও উপচে পড়া ভিড়। নেইমার আছেন, ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো আছেন, হ্যারি কেন আছেন, লুকা মদ্রিচ, কিলিয়ান এমবাপে আছেন। কিন্তু মেসির চাহিদা আকাশছোঁয়া। জার্সি, পোস্টার, লোগোতে ঈশ্বর আরাধনা চলছে কাতারে।

সি-লাইনের অপরূপ দৃশ্য় মন ভুলিয়ে দেবে। সমুদ্রের বুকে সাঁতার কেটে বেড়ানো দুধসাদা ক্রুজ়, নাইন-ফোর-সেভেন স্টেডিয়াম, এলইডি লাইটে মোড়া রাস্তার দু’পাশের খেজুর গাছ। এক ঝলকে মনে হবে, আপনি দীপাবলির কলকাতায় চলে এসেছেন। আর সেখানেই দেখা মিলল ব্রাঙ্কোর সঙ্গে। দুই বাহুতে মারাদোনা আর মেসিকে নিয়ে হাজির হয়েছেন কাতারে। ফ্যানস ভিলেজে ঢোকার মুখে বছর কুড়ির তরুণ বলে দিলেন, ‘এক ঈশ্বর আমাদের বিশ্বকাপ দিয়েছিল ৩৬ বছর আগে। এত দিনের খরা, অভাব মিটিয়ে দেবে আর এক ঈশ্বর। মারাদোনা আর মেসির ট্যাটু এই কারণে খোদাই করে ফেলেছি।’ সমুদ্রের নোনা হাওয়া আর নিয়ন আলোর ছটায় স্বপ্নালু দেখাচ্ছিল ব্রাঙ্কোকে।

ফুটবল ঈশ্বর মেসির ঠিকানা এখন কাতার। দেশের হয়ে প্রান্তিক স্টেশনও তো! সি-লাইনে ন্যাশনাল লাইব্রেরির ধারে বিখ্যাত টাওয়ারটার কথাই বলি। পঞ্চাশ ফুটের ডিজিটাল কাটআউট তৈরি করা হয়েছে এলএম টেনের। সারাক্ষণ স্মিত হাসি নিয়ে বল ড্রিবল করে যাচ্ছেন মেসি। কখনও গোলের পর দু’হাত তুলে ঈশ্বরকে গোল নিবেদন করা। একবার বুকে দু’হাত জড়ো করে দাঁড়াচ্ছেন। ওই ডিজিটাল কাটআউটের সামনে থমকে দাঁড়াচ্ছে দোহা, কাতার, আর্জেন্টিনা, লাতিন আমেরিকা, বিশ্ব! মনে মনে কুর্নিশ করে যাচ্ছেন মেসিকে। বুকের বাঁদিকে ডান হাত ছুঁইয়ে বিড়বিড় করে প্রার্থনাও করছেন অনেকে।
Share To:

kakdwip.com

Post A Comment:

0 comments so far,add yours