পরিবেশ আদালতের রায়ে সুন্দরবন জুড়ে প্লাস্টিক নিষিদ্ধ। তবে বাস্তব পরিস্থিতি বলছে, বেসরকারি ত্রাণ, মিড ডে মিল, স্থানীয় বাজার এবং পর্যটনের হাত ধরে প্লাস্টিক বর্জ্যের পাহাড় জমছে সুন্দরবনের বুকে। হুঁশ নেই প্রশাসনের।

ব্লক প্রশাসন সূত্রের খবর, হিঙ্গলগঞ্জ ব্লক জুড়ে প্রতি মাসে ১৮,১৫৭ জন পড়ুয়া মিড ডে মিল পায় প্রাথমিক ও হাইস্কুল মিলিয়ে। অর্থাত্‍, মিড ডে মিল দেওয়ার জন্য গড়ে চারটে পৃথক প্যাকেট করতে হয়। যেমন, এ বার দেওয়া হচ্ছে চাল, ডাল, চিনি, আলু, সাবান, সয়াবিন। তাই ৪টি আলাদা প্যাকেট করতেই হচ্ছে। ফলে এক একজন পড়ুয়ার কাছে যাচ্ছে ৪টি করে প্লাস্টিক ব্যাগ। একবার মিড ডে মিল এ ভাবে দিলে হিঙ্গলগঞ্জের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে যাচ্ছে ৭২,৬২৮ প্লাস্টিক ব্যাগ!


জুন মাস ধরে এখনও পর্যন্ত এ ভাবে মিড ডে মিল দেওয়া হয়েছে ১৫ বার। অর্থাত্‍, ইতিমধ্যে হিঙ্গলগঞ্জে শুধুমাত্র মিড ডে মিলের দৌলতে ১০ লক্ষ ৮৯ হাজার ৪২০টি প্লাস্টিক ব্যাগ জমেছে। প্রায় সব স্কুল প্লাস্টিকের ব্যাগে করেই মিড ডে মিল দেয়। সুন্দরবনের বুক থেকে এই প্লাস্টিক বর্জ্য উদ্ধারে বা প্লাস্টিক দূষণ রোধে প্রশাসন সম্পূর্ণ নীরব দর্শক বলে অভিযোগ।

সারা বছর ধরেই বিভিন্ন ভাবে হিঙ্গলগঞ্জের বিভিন্ন প্রান্তে প্লাস্টিক জমছে। যেহেতু হিঙ্গলগঞ্জের কোথাও প্লাস্টিক ব্যবহার নিয়ে কোনও বিধিনিষেধ কার্যকর নেই, তাই সারা বছর ধরে সুন্দরবন ঘুরতে আসা পর্যটকেরাও দেদার প্লাস্টিক ও থার্মোকলের প্লেট ব্যবহার করেন। কালীতলা পঞ্চায়েত এলাকার মতো সুন্দরবন থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বেও কোনও বিধিনিষেধ কার্যকর নেই প্লাস্টিক বা থার্মোকলের প্লেট ব্যবহার নিয়ে। দেদার ব্যবহার হয় প্লাস্টিক। সেই সব বজ্য ফেলা হয় পাশের নদীতে, যে নদীর বিপরীত দিকেই সুন্দরবন।

একই অবস্থা দেখা যায় এই পঞ্চায়েতের সামসেরনগর বাজার এলাকা-সহ বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্র এবং এবং নদীর পাশে। শীতের মরসুমে বেশি করে চোখে পড়ে প্লাস্টিক বর্জ্য।

পরিবেশবিদ সুদীপ্ত ভট্টাচার্য জানান, প্লাস্টিক বর্জ্য মাটির বা বাঁধের ভূমিক্ষয় বাড়িয়ে দেয়। সেই সঙ্গে গ্রামের বিভিন্ন নিকাশি নালায় প্লাস্টিক বর্জ্য জমে থাকায় বিপত্তি হয় বর্ষায়। সুদীপ্ত বলেন, 'সুন্দরবনের বিভিন্ন নদীর পাশের ম্যানগ্রোভের শ্বাসমূলে প্লাস্টিক বা থার্মোকলের প্লেট আটকে থাকতে দেখা যায়। যা ক্ষতিকর। প্লাস্টিক সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্র, জীববৈচিত্র্যকে ক্ষতি করছে। অবিলম্বে প্রশাসনকে প্লাস্টিক ব্যবহার নিষিদ্ধ করতেই হবে।'

পরিবেশবিদ সুভাষ দত্ত বলেন, ''পরিবেশ আদালত রায় দিয়েছে, গোটা সুন্দরবন এলাকা জুড়ে প্লাস্টিক নিষিদ্ধ করতে। হিঙ্গলগঞ্জের মতো এলাকাতেও এই রায় প্রযোজ্য। সুন্দরবনের অন্য প্রান্তের মতো এখানেও প্রশাসনের কোনও হেলদোল নেই বলে জানতে পারছি। সুন্দরবন জুড়ে প্রশাসনের এই চূড়ান্ত উদাসীনতার বিষয়টি নিয়ে আমি ফের পরিবেশ আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করব।' সুভাষ আরও বলেন, ''প্লাস্টিক বর্জ্য উদ্ধার প্রয়োজন। তবে প্লাস্টিক পরিবেশে ছড়িয়ে পড়া রোধের জন্য সক্রিয় হতে হবে প্রশাসনকে। কারণ, একবার সুন্দরবন এলাকায় প্লাস্টিক পড়লে নদীপথে ভেসে ভেসে বহু কিলোমিটার দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে পারে।''

সম্প্রতি প্লাস্টিক বর্জ্য উদ্ধারে এগিয়ে এসেছে কলকাতার একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। হিঙ্গলগঞ্জের রূপমারি পঞ্চায়েতের বিভিন্ন জলমগ্ন এলাকায় ইয়াসের পরে থেকে এখনও বেসরকারি ত্রাণ আসছে। ত্রাণের সঙ্গে বিপুল প্লাস্টিক জমছে। বিভিন্ন ভাবে এলাকায় জমে থাকা প্লাস্টিক এখন সর্বত্র জলে ভাসছে। এই সব প্লাস্টিক উদ্ধার করতে কিছু দিন আগে কলকাতার একটি সংগঠন আসে। স্থানীয় মহিলারা প্রায় ৬১টি বস্তা প্লাস্টিক রুপমারি পঞ্চায়েতের শুধু বচনপল্লি গ্রাম থেকে সংগ্রহ করে দেন তাঁদের। তার বিনিময়ে একটা করে ত্রিপল বা মশারি দেওয়া হয়। এ ছাড়া, সংগঠনের পক্ষ থেকে শিক্ষক সমীরকুমার মান্না স্থানীয়দের প্লাস্টিক দূষণ নিয়ে সচেতন করেন। সংগঠনের তরফে মৈত্রী বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, 'এই প্লাস্টিক ফের ব্যবহারের জন্য আনা হয়েছে। ব্লক প্রশাসনের সাহায্য পেলে আমাদের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা আছে সুন্দরবনে প্লাস্টিক ছড়িয়ে পড়া রোধ করা এবং উদ্ধার করা নিয়ে।'

স্থানীয় পঞ্চায়েতের প্রধান সনাতন সর্দার বলেন, 'এলাকায় জমে থাকা বিপুল প্লাস্টিক উদ্ধারের বিষয়টি দ্রুত দেখা হবে।'

বারাসত স্টেট ইউনিভার্সিটির প্রাক্তন উপাচার্য বাসব রায়চৌধুরী বলেন, 'এই সব এলাকার প্লাস্টিক নদী থেকে সমুদ্র পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছবে।যা জলজ জীবদের জন্য খুবই বিপজ্জনক। সংগঠনটির কাজ খুব প্রশংসনীয়।'

শুধু রূপমারি এলাকা নয়, হিঙ্গলগঞ্জ ব্লকের মামুদপুর এলাকাতেও ত্রাণের হাত ধরে বহু প্লাস্টিক জমেছে। হিঙ্গলগঞ্জের বিডিও শাশ্বতপ্রকাশ লাহিড়ি বলেন, ''প্লাস্টিক দূষণ রোধে দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করা হবে।' — নিজস্ব চিত্র
Share To:

kakdwip.com

Post A Comment:

0 comments so far,add yours