১৯০৮ সালের ১১ আগস্ট। ভোর প্রায় ছটা। মুজফফরপুর জেলে জোরকদমে চলছে আয়োজন। ভয়ংকর সেই ‘অপরাধী’র ফাঁসি হবে আজ। এবার বাঙালি এবং ভারত দেখবে, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে কিছু করতে গেলে কীরকম পরিণতি হয়। আয়োজনও প্রায় শেষ। ১৫ ফুট উঁচু ফাঁসির মঞ্চ; দুই দিকে খুঁটি, আড়াআড়ি রডের ঠিক মাঝখানে ঝুলছে মারণ ফাঁস। কিছুক্ষণ পর আসামি এলেন; হাত পিছমোড়া করে বাঁধা। ঘরে দাঁড়িয়ে আইনজীবী এবং ব্রিটিশ পুলিশরা। তাঁদের দিকে তাকিয়ে একবার প্রাণ ভরে হেসে নেন ক্ষুদিরাম বসু। তারপর একটু একটু করে এগিয়ে যান মঞ্চের দিকে…

মেদিনীপুরের এক দামাল কিশোর কী করে যেন জড়িয়ে গিয়েছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে। তবে এই নেশা একবার যার রক্তে ঢোকে, তার কাছে সাধনার বস্তু হয়ে দাঁড়ায়। ক্ষুদিরামেরও তাই হয়েছিল। কিশোর বয়সের নানা ঘটনা পেরিয়ে এল বড়ো কাজ। অত্যাচারী ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে হত্যা করতে হবে। এই কাজের জন্য প্রথমে অবশ্য বাছা হয়েছিল প্রফুল্ল চাকী এবং সুশীল সেনকে। শেষমুহূর্তে বিশেষ কারণে সুশীল সেন যেতে পারেননি। তার জায়গায় দলে ঢোকেন ক্ষুদিরাম। ভয়? সেই শব্দটি তাঁর অভিধানে কোনদিনও ছিল না। শুধু পরিকল্পনাটা যাতে ঠিকঠাকভাবে হয়, সেই দিকেই ছিল নজর। 

এরপরের ঘটনা আমাদের সবার জানা। সামান্য ভুলের জন্য বেঁচে যান কিংসফোর্ড। শুরু হয় প্রফুল্ল আর ক্ষুদিরামের আত্মগোপনের জীবন। পুলিশের হাতে ধরা দেবেন না কিছুতেই। কিন্তু শেষরক্ষা হয় না। কথায় বলে ঘরের শত্রু বিভীষণ। স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস দেখলে এমন অনেক ভারতীয় ও বাঙালিদেরই দেখা যাবে যারা ব্রিটিশদের হয়ে কাজ করেছে অথবা পুরস্কারের লোভে বিপ্লবীদের ধরিয়ে দিয়েছে। মুজফফরপুর থেকে রওনা দেওয়া একটি ট্রেনে প্রফুল্ল চাকীর ওপর সন্দেহ হয় সিংভূমের পুলিশ সাব-ইন্সপেকটর নন্দলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের। পরে গ্রেফতার করতে গেলে নিজের বন্দুক দিয়েই গুলি চালিয়ে আত্মহত্যা করেন প্রফুল্ল। পরে ধরা পড়েন ক্ষুদিরামও। 
গোটা মামলা চলাকালীন অভাব ছিল না সাক্ষীরও। সব মিলিয়ে প্রায় তিরিশের কাছাকাছি। বোমা বিস্ফোরণে মৃত মিসেস ও মিস কেনেডির সহিস লুরফাতও ছিলেন তাঁদের মধ্যে। ঘটনায় তিনিও আহত হয়েছিলেন। তবে এর থেকে বেশি কিছু বলা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। এছাড়াও ইন্সপেকটর লতিফুল হোসেন, ডেপুটি সুপার বাচ্চু নারায়ণলাল, পোস্টাল পিওন ত্যাগেশ্বর তেওয়ারি-সহ আরও অনেকে। এই সাক্ষীদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের বয়ান ছিল গুরুত্বপূর্ণ। যেমন বাচ্চু নারায়ণলাল। ঘটনাটা যেখানে ঘটেছিল, সেই ক্লাবের কাছেই তাঁর বাড়ি। বোমার আওয়াজ শোনার পর নিজের উদ্যোগেই সমস্ত জায়গায় তল্লাশির কাজ শুরু করেন। এছাড়া তিনিই দীনেশ ওরফে প্রফুল্ল চাকীর মরদেহ মুজফফরপুরে নিয়ে এসেছিলেন। প্রসঙ্গত, এই পুরো ঘটনায় ক্ষুদিরাম-প্রফুল্লকে সাহায্য করেছিলেন কিশোরীমোহন বলে এক ব্যক্তি। তাঁকে গ্রেফতার করার ব্যাপারেও এঁর ভূমিকা ছিল। 

তবে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী হিসেবে উঠে এসেছিলেন একজন পিওন, ধর্মশালার দপ্তরী এবং একজন এক্কাচালক। দুজন বাঙালি যুবক যে ধর্মশালায় উঠেছে, আর কিশোরীবাবু যে তাঁদের চেনেন এই ব্যাপারটায় শিলমোহর দেন তিনি। তবে চিহ্নিতকরণের কাজটি করতে পারেননি। সেটি করেছিল এক্কাচালক। এইভাবেই এগোতে থাকে বিচারপর্ব। একজনের বিচার তো আগেই হয়ে গেছে; আরেকজনের যে কী হবে সেটা জানতে বাকি ছিল না কারোর। ক্ষুদিরামের ফাঁসির আদেশ শুনে গোটা বাংলা ফেটে পড়েছিল। রাস্তায় নেমে পড়েছিল মানুষ। এমন ঘটনা কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি কেউ। 

আর ক্ষুদিরাম? তাঁকে যতই লোকে দেখে, অবাক হয়ে যায়। মৃত্যু সামনে দাঁড়িয়ে, অথচ তিনি গান গাইছেন স্বাধীনতার। বলে যাচ্ছেন, যদি একবার সুযোগ পাই, বাংলার ছেলেদের বোমা বাঁধানো শিখিয়ে যাব। একটা নয়, হাজার হাজার ক্ষুদিরাম তৈরি হবে এবার। আইনজীবী সতীশচন্দ্র চক্রবর্তী বারবার করে বলছেন, রংপুর থেকে উকিলরা তোমাকে বাঁচাতে আসছে; আর তুমি তোমার কৃতকর্ম স্বীকার করে নিচ্ছ? অকপট ক্ষুদিরাম, ‘স্বীকার না করার কী আছে?’ গায়ে তখনও রক্ত ফুটছে। ব্রিটিশ পুলিশরাও অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সদ্য আঠেরো পেরনো ছেলেটির দিকে… 

১১ আগস্টের মঞ্চ প্রস্তুতই ছিল। বীরদর্পে এগিয়ে গেলেন ক্ষুদিরাম। চারপাশের মানুষদের যেন কটাক্ষ ছুঁড়ে দিল তরুণটি। ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে জল্লাদ দড়ি পরাতে যাবে, এমন সময় ক্ষুদিরাম জল্লাদকে প্রশ্ন করে বসল। ‘আচ্ছা, ফাঁসির দড়িতে মোম দেওয়া হয় কেন?’ জল্লাদ থ! মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে এমন আচরণ ক্ষুদিরামই করতে পারেন। গলায় পরানো হল কাপড়। ফাঁস আঁটল মোম-লাগা দড়ির। ভোর ঠিক ছটা। রুমাল উড়ল। তারপর...

তথ্যসূত্র- ‘মূল নথি থেকে ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকী’/ দে’জ পাবলিশিং 


Share To:

kakdwip.com

Post A Comment:

0 comments so far,add yours