১৯৭০ সালে ব্যাপক পুলিশী ধরপাকরের মধ্যে ধরা পড়ে যান আজিজুল। আজিজুল হককে পেলে শুট টু কিলের অর্ডার ছিল। আজিজুল ধরা পড়েছে জানতে পেরে ভূপেশ গুপ্ত ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে কথা বলে তাঁকে রক্ষা করেন।


বাবার বিরুদ্ধে লড়াই করে জমি ফিরিয়েছিলেন চাষিদের, প্রয়াত নকশালবাড়ি আন্দোলনের অন্যতম নেতা বাম চিন্তাবিদ আজিজুল হক
প্রয়াত আজিজুল হক




 বাম চিন্তাবিদ আজিজুল হক প্রয়াত। সোমবার দুপুরে সল্টলেকের এক বেসরকারি হাসপাতালে মৃত্যু হয় তাঁর। বেশ কিছুদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন প্রবীণ বামপন্থী চিন্তাবিদ আজিজুল হক। কয়েক দিন আগেই ভর্তি করানো হয় বেসরকারি হাসপাতালে। রবিবার অবস্থার অবনতি হলে ভেন্টিলেশন সাপোর্ট দেওয়া হয়। সোমবার দুপুর ২.২৮ মিনিটে সব শেষ! তাঁর প্রয়াণে শোক প্রকাশ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।






বাবা সৈয়দ কাশেম, দোর্দণ্ডপ্রতাপ ধর্মপ্রাণ জমিদার। মা হাজারা বেগম। মায়ের চিন্তা-ভাবনায় বড় হয়ে উঠেছিলেন আজিজুল। খুব ছোটবেলাতেই দাদাদের সঙ্গে পড়াশোনা করতে চলে আসেন কলকাতায়। সেখানেই, আইএসসি পড়তে পড়তে নন্দগোপাল ভট্টাচার্যের সঙ্গে পরিচয় এবং স্বাভাবিকভাবেই কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন।

নন্দবাবু তাঁকে নিয়ে যান বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায়ের কাছে। ১৯৫৯ সালে নন্দগোপাল ভট্টাচার্য, বিশ্বনাথের প্রভাবে ছাত্র ফেডারেশনে যোগদান। খাদ্য আন্দোলনের মিছিলে আহত। তারপর থেকে ধারাবাহিকভাবে আন্দোলনে থাকা। ১৭ বছর বয়সে (এক বছর বয়স বাড়িয়ে) অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। ক্রমশ ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে উঠে আসা।

ছাত্র আন্দোলনের পাশাপাশি আজিজুল হক যোগদান করেন হাওড়া জেলা কৃষক সমিতিতে। মহকুমা কৃষক সমিতির সম্পাদক হন। নিজের বাবার বিরুদ্ধেই আন্দোলন করে কৃষকদের মধ্যে সেই জমি বিলিয়ে দেন। সেই সময় থেকেই সশস্ত্র বিপ্লব বিষয়ে চিন্তাভাবনা শুরু। কিন্তু একইসঙ্গে জ্যোতি বসুর ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। যদিও রাজনৈতিক ভাবে তাঁর লাইনের প্রবল বিরোধী। ১৯৬৪ সালের শেষে জেলে চলে যান। ৬৫ সালে মুক্তি। শেষ যুক্ত কৃষক কনফারেন্সে “লাঙল যার জমি তার” স্লোগানের বিরোধিতা করে লেনিনের “ল্যান্ড টু দ্য টিলার্স” স্লোগানকে সামনে রেখে আওয়াজ তোলেন “যে চাষ করে, জমি তার।”

১৯৭০ সালে ব্যাপক পুলিশী ধরপাকরের মধ্যে ধরা পড়ে যান আজিজুল। আজিজুল হককে পেলে শুট টু কিলের অর্ডার ছিল। আজিজুল ধরা পড়েছে জানতে পেরে ভূপেশ গুপ্ত ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে কথা বলে তাঁকে রক্ষা করেন। কিন্তু জেলে গিয়েও সংগ্রাম জারি রাখেন আজিজুল। ৭২ সালে জেলের ভেতরে পুলিশের আঘাতে আহত হন তিনি এবং নিশীথ ভট্টাচার্য। ১৯৭৬ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি জেল ভাঙেন। নেতৃত্বে ছিলেন আজিজুল হক এবং নিশীথ ভট্টাচার্য। এই সংগ্রামে শহিদ হন কালু হালদার এবং স্বদেশ ঘোষ। বাইরে বেরিয়ে তৈরি করেন চার মজুমদারপন্থী সিপিআই (এম-এল) দ্বিতীয় কেন্দ্রীয় কমিটি। দীর্ঘ পাঁচ, ছয় বছর ধরে দ্বিতীয় কেন্দ্রীয় কমিটির গেরিলা লড়াই চলে পশ্চিমবাংলা ও বিহারের বিভিন্ন জেলায়।

১৯৮২ সালের জুলাই-অগস্ট মাসে ঘোলার এক প্রেস থেকে পুলিশের জালে ধরা পড়েন আজিজুল। বামফ্রন্ট আমলে জেলে জান এবার। অকথ্য অত্যাচার চলে। তার মুক্তির দাবিতে সরব হন সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে বাংলার বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীরা। ১৯৮৯ সালের ২৫ ডিসেম্বর মুক্তি পান আজিজুল। বেরিয়ে এসে গণ-আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যান, শুরু হয় লেখালেখি। তার বিখ্যাত বই কারাগারে ১৮ বছর প্রকাশিত হয় ১৯৯০-৯১ সালে। তারপর থেকে একটানা লিখেছেন, থেকেছেন আন্দোলনের ময়দানে।

সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের পর্বে আজিজুল তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সমর্থন জানান বামফ্রন্টকে। তিনি তৃণমূলী শক্তির বিরুদ্ধে বামফ্রন্টের প্রতি সমালোচনামূলক সমর্থন দেন এবং তার বিরোধী ও তৃণমূলের পক্ষাবলম্বনকারী শক্তিগুলোকে নির্মমভাবে সমালোচনা করেন। এই নিয়ে ব্যাপক কুৎসা এবং আক্রমণের সম্মুখীন হতে হয় তাঁকে। কিন্তু তারপরেও তিনি যা বিশ্বাস করেছেন তা স্পষ্ট ভাবে উচ্চারণ করেন। বাংলায় ক্ষমতা পরিবর্তন হয়ে যাবার পরেও বিভিন্ন প্রতিবাদে ও প্রচারে আজিজুল হক অংশগ্রহণ করেন, কিন্তু ক্রমশ তাঁর শরীর ভেঙে যেতে আরম্ভ করে। পারকিনসনস্-এর প্রকোপে তাঁর লেখালেখি সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। গতবছর (২০২৪) “পরিচয়” পত্রিকার শারদ সংখ্যায় দীর্ঘদিন পর তাঁর একটি সাক্ষাৎকার ভিত্তিক আত্মজীবনীমূলক লেখা প্রকাশিত হয়।
Share To:

kakdwip.com

Post A Comment:

0 comments so far,add yours