দিলীপের জমানায় শুধুমাত্র হিন্দুত্বে ভর করে আর বেপরোয়া বোল চাল নিয়ে বিজেপি লড়েছিল। অবশ্যই সাফাল্য এসেছিল। কিন্তু ২০২১ পরবর্তী সময়ে দেখা যায়, বিজেপি শুধু হিন্দুত্বের লড়াই লড়ছে না, তার সঙ্গে মুসলিম বিরোধী অবস্থানও নিচ্ছে। কিন্তু শমীক কী বদলাচ্ছেন রণকৌশল?

মুসলিমদের কাছে টানতে শমীকের 'আড়াই চাল'!
চাপানউতোর চলছে রাজনৈতিক মহলে


“আমরা নতুন ভারত তৈরি করতে চাই। আসুন আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করুন। মুসলিমদের সঙ্গে নিয়ে এবার আমরা ভোটে লড়ব।” ২০০৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি এই কথা বলেছিলেন অটল বিহারী বাজপেয়ী। নির্বাচন ছিল এপ্রিলে। অর্থাৎ হাতে এক দেড় মাস। কিন্তু শমীকের হাতে রয়েছে ৮ মাস সময়। তাই কি, বাজপেয়ীর ভাবশিষ্য প্রথম দিনেই বিড়ালের গলায় ঘণ্টাটা বেঁধে দিলেন। সম্প্রতিক কালে বঙ্গ বিজেপি যেভাবে চলে এসেছে, তার থেকে একটু আলাদা পথে হেঁটে সংখ্যালঘুদের যে বার্তা দিলেন, তাতে স্পষ্ট বাজপেয়ীর দেখানো পথেই হাঁটতে চলেছেন শমীক। কিন্তু, এই পথে কি সাফল্য আসবে? কোন অঙ্কে খেলতে চাইছেন শমীক? চলুন, একবার খোঁজার চেষ্টা করি আমরা। 




স্ত্রী-দুই সন্তানকে নিয়ে হন্যে হয়ে স্টেশনে ঘুরছিলেন ব্যক্তি, একটা ভুলের জন্য বিরাট ক্ষতি...এখন রেলকে দিতে হবে মোটা অঙ্কের জরিমানা!
ভানুর হার্ট অ্যাটাক, সৌমিত্রকে ফোন করলেন ভানুর স্ত্রী, এরপর সৌমিত্র যা করলেন তা অবিশ্বাস্য
Shamik Bhatt BJP

সংখ্যালঘু নিয়ে শমীকের মন্তব্যের ব্যাখ্যায় আসতে গেলে আগে বুঝতে হবে কে এই শমীক? এই বিজেপিকে কতটা চেনেন শমীক? ১৯৮০ সালে বিজেপির জন্মলগ্ন থেকেই সমান্তরালভাবে হেঁটে চলেছেন শমীক ভট্টাচার্য। তার আগে ছাত্র রাজনীতি এবং RSS করেছেন। অসাধারণ বাগ্মীতায় যে কোনও প্রতিপক্ষকে কুপোকাত করতে পারেন তিনি। বাজপেয়ীর বক্তৃতা থেকে শক্তি চাট্টুজ্যের কবিতা জলের মতো বলে ফেলতে পারেন। আর তাঁর ঝুলিতে আছে ৪ দশকের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা। কিন্তু এ সব নিয়েই কি রাজ্য সভাপতি পদের মতো এত বড় গুরুভার সামলাতে পারবেন। 

তাহলে এটাও জানতে হবে শমীকের কাছে কী নেই! শুভেন্দু অধিকারীকে অনেকে যোমন মাস লিডার বলেন, তেমন উপাধি কিন্তু আজ অবধি জোটেনি শমীকের। কাকদ্বীপ থেকে কালিম্পং পর্যন্ত তৃণমূল স্তরে পরিচিতি নেই। আবার এই কয়েক বছরে সুকান্ত মজুমদার যে গায়ে গতরে খেটে একটা জনপ্রিয়তা তৈরি করেছেন বা সংসদীয় রাজনীতিতে দু’বার সাংসদ হওয়ার সুবাদে শমীকের থেকে অনেকটাই এগিয়ে আছেন। তাছাড়া কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হিসাবে সুকান্তের কিছুটা অভিজ্ঞতা হয়েছে। চার দশক ধরে পদ্মফুল নিয়ে হাঁটলেও বিজেপির মুখপাত্র ছাড়া তেমন উল্লেখযোগ্য পদ পাননি শমীক। তাই ২০২৬ সালে হাইপ্রোফাইল যুদ্ধে বিজেপির রাজ্য সভাপতির এই পদ তাঁর কাছে যে অত্যন্ত চ্যালেঞ্জের তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

বঙ্গ বিজেপির ‘সংখ্যালঘু নীতি’

বাংলায় বিজেপি নিয়ে আলোচনা করতে হলে দিলীপ ঘোষ টু সুকান্ত মজুমদারের প্রসঙ্গ আসবেই। ২০১৫ সালে রাহুল সিনহার হাত থেকে ব্যাটন নিয়ে দৌড় দিয়েছিলেন দিলীপ। RSS করা গোঁড়া হিন্দুত্বের বার্তা নিয়ে কার্যত ঝড় তুলেছিলেন দিলীপ ঘোষ। ২০১৯ লোকসভায় ২ থেকে ১৮ এবং ২০২১-এ ৩ থেকে ৭৪টি আসন নিয়ে ব্যাটন তুলে দেন সুকান্ত হাতে। আর সুকান্তর জমানায় ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে ১৮টি আসন থেকে কমে দাঁড়ায় ১২টি আসনে। ২০১৯-এ পাওয়া ৪০ শতাংশ ভোট কমে দাঁড়ায় ৩৮.৭৩ শতাংশ। ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনে ভোট শতাংশ ছিল ৩৮.১৪ শতাংশ। মনে হতে পারে এই তথ্যগুলো হঠাৎ কেন দিলাম! এই তথ্যের মধ্যে লুকিয়ে আছে বিজেপির ‘সংখ্যালঘু নীতি’। 

দিলীপের জমানায় শুধুমাত্র হিন্দুত্বে ভর করে আর বেপরোয়া বোল চাল নিয়ে বিজেপি লড়েছিল। অবশ্যই সাফাল্য এসেছিল। কিন্তু ২০২১ পরবর্তী সময়ে দেখা যায়, বিজেপি শুধু হিন্দুত্বের লড়াই লড়ছে না, তার সঙ্গে মুসলিম বিরোধী অবস্থানও নিচ্ছে। শুভেন্দু অধিকারীর মুখেই শোনা গিয়েছে, যারা আমাদের সঙ্গে নেই, আমরাও তাদের সঙ্গে নেই। আসব, এই বিষয়টা নিয়ে আসব। কিন্তু যেটা বলার, শমীকযুগ শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত হিন্দুত্বের উপর ভীষণ জোর এবং মুসলিম ভোটের উপর ভরসা না করে এগিয়ে চলার চেষ্টা করেছে দলটি।

শুভেন্দু ও হিন্দুত্ব



রাজনীতির কারবারিদের বড় অংশ বলছেন, ক্ষমতায় আসতে দু’টো বিষয়ের উপর ভীষণভাবে জোর দিচ্ছেন বঙ্গ বিজেপির হিন্দুত্বের পোস্টার বয় শুভেন্দু অধিকারী। এক, হিন্দু ভোট এককাট্টা করা। কোনও ভাবে হিন্দুভোটকে ভাগ করা যাবে না। দুই, মুসলিম ভোট তাঁর দরকার নেই। কিন্তু শুধুই কি হিন্দু ভোট নিয়ে বাংলায় ক্ষমতায় আসা সম্ভব? 

শমীক কি অঙ্কটা ভাল বোঝেন? 

শুভেন্দু অধিকারী বলেছিলেন, আমরা ৩৯ শতাংশ আছি, আর ৫-৬ শতাংশ হিন্দুরা একজোট হলেই ক্ষমতায় আসা সম্ভব। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সব হিন্দু কি বিজেপির? কালীগঞ্জের উপনির্বাচনই ধরুন। তথ্য বলছে, সংখ্যালঘু অধ্যুষিত কালীগঞ্জ বিধানসভায় শুধু মুসলিমরাই তৃণমূলকে ভোট দেননি, অনেক হিন্দুও তৃণমূলকে ভোট দিয়েছে। ২৬-এর আগে কালীগঞ্জ, উপনির্বাচন হলেও একটা ওয়ার্ম-আপ ম্যাচ ছিল। সেখানেই প্রমাণ হল, সব হিন্দুরা বিজেপিকে ভোট দিচ্ছেন না।

দুই, বিজেপির হিন্দু ভোট ব্যাঙ্কও প্রায় স্যাচুরেশন জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে, যদি না বাম-কংগ্রেসের আরও বেশি ভোট ব্যাঙ্কের ক্ষয় হয়। তাহলে এই ৫-৬ শতাংশ ভোট শুধু মাত্র হিন্দুদের কাছ থেকে পাওয়ার আশা কি বোকামি হয়ে যাবে না তো? এখানেই আসে শমীকের অঙ্ক! কোনও ছুঁৎমার্গ না রেখে সরাসরি সংখ্যালঘুদের উদ্দেশ্যে দিলেন বার্তা। সভাপতিত্ব গ্রহণের মঞ্চ থেকে স্পষ্ট বললেন, “বিজেপির লড়াই সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে নয়। আমরা লড়ছি, আপনাদের জন্য। আমরা চাই আপনাদের বাড়ির ছেলেদের হাত থেকে পাথর কেড়ে বই দিতে। যারা তলোয়ার নিয়েছে, তাদের হাতে কলম ধরিয়ে দিতে চাই। এটাই বিজেপির লড়াই। এটা করে দেখাবে।”

শুধু কি হাওয়ায় এমন বার্তা দিলেন। সত্যিই সত্যিই কি মুসলিমরা ভোট দেবেন তার প্রমাণ কী। এখানেই রাজনীতির কারিবারিদের একটা পর্যবেক্ষণ রয়েছে। কী সেই পর্যবেক্ষণ? 

তৃণমূলের সংখ্যালঘু ভোট

আমরা দেখেছি প্রথম থেকেই মুসলিমদের অধিকাংশ ভোটই তৃণমূলের দিকে গিয়েছে। সম্প্রতি NRC, CAA বিভিন্ন ইস্যুকে হাতিয়ার করে মুসলিম ভোট ব্যাঙ্ককে এককাট্টা করতে সক্ষম হয়েছে তৃণমূল। কিন্তু সেটাও একটা স্যাচুরেশন পয়েন্টে পৌঁছে গিয়েছে বলে অভিমত রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের। তার উপর দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় থাকায় একটা অ্যান্টি ইনকামবেন্সি ফ্যাক্টর তৈরি হয়েছে। তাই ছওট হলেও একাংশের সংখ্যালঘুরা মুখ ফেরাচ্ছে বলে অভিমত কারও কারও। তবে এটাকে ফাটল বলা ভুল হলেও ছোটখাটো চিড় তো ধরছেই। সম্প্রতি ফুরফুরা শরিফ থেকে গ্রন্থগার মন্ত্রী সিদ্দিকুল্লা চৌধুরীর ঘটনাই তার প্রমাণ!

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশের মতে, যদি এই জায়গায় বিজেপি নিজেদের দিকে এইসব বিক্ষুদ্ধ মুসলিমদের টানতে পারলে, এই ৫-৬ শতাংশ ডেফিসিট পূরণ করা সম্ভব। শমীক সেই অঙ্কটাই হয় তো কষার চেষ্টা করছেন। কিন্তু দলের ভিতরে এই নিয়ে কোনও চাপা গুঞ্জন শুরু হয়ে গেছে কি? 

শমীক যদিও বলছেন শুভেন্দু অধিকারী যা বলেছেন আমিও কাল সে কথা বলেছি। শব্দচয়ন এবং শরীরি ভাষা একান্তই বক্তার ব্যক্তিগত। শুভেন্দু ভোট হিন্দু ভোট এককাট্টা করার কথা বলছেন, আর আমি বলছি যদি মুসলিমরা ভেবে থাকেন তাঁদের ভোট ছাড়া পশ্চিমবঙ্গে পরিবর্তন করা যাবে না, তৃণমূলের বিসর্জন হবে না, তাহলে তাঁরা ভুল ভাবছেন। কেন বললেন, তার ব্যাখাও দিলেন। বললেন, “শুভেন্দু অধিকারী যা বলেছেন আমিও কাল সে কথা বলেছি। শব্দচয়ন এবং শরীরি ভাষা একান্তই বক্তার ব্যক্তিগত। শুভেন্দু ভোট হিন্দু ভোট এককাট্টা করার কথা বলছেন, আর আমি বলছি যদি মুসলিমরা ভেবে থাকেন তাঁদের ভোট ছাড়া পশ্চিমবঙ্গে পরিবর্তন করা যাবে না, তৃণমূলের বিসর্জন হবে না, তাহলে তাঁরা ভুল ভাবছেন। আমাদের ভোট দেওয়ার দরকার নেই। তাও বিজেপি ক্ষমতায় আসবে। সেটাই শুভেন্দু বলছেন।” ঠিক এরপরই তাঁর সংযোজন, “আমাদের লড়াই ধর্মান্ত ইসলামিক ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে।”

‘বহুত্ববাদটাই হিন্দুত্ব’ 

খেলা এখানেই শেষ নয়, শমীকের সভাপতিত্ব গ্রহণের মঞ্চজুড়ে ছিল কালীঘাটের কালীর ছবি। এদিন সে প্রসঙ্গ উঠতেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কাঠগড়ায় তুলে খোঁচার পর খোঁচা দিয়ে গেলেন। বললেন, “কালীঘাটের কালী বলে দিয়েছেন তুমি আমার প্রতিবেশী হতে পারো, কিন্তু তুমি যা করেছ তাতে আমি তোমার ফাইল নিতে পারব না।”

সোজা কথায়, তৃণমূল রোধের স্টাইল যে বদলাচ্ছে বঙ্গ বিজেপি তা হাবেভাবে ঠারেঠারে বুঝিয়ে দিলেন তিনি। কালী, জগন্নাথের পাশাপাশি টেনে আনলেন এক্কেবারে বিবেকানন্দকেও। নতুন করে বোঝালেন হিন্দুত্ববাগের সংজ্ঞা। শনিবার সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে বললেন, “হিন্দুত্ব কোনও বাদ হতে পারে না। বহুত্ববাদটাই হিন্দুত্ব।” সঙ্গে এও বললেন, “বিজেপি আদিলগ্ন থেকে যে রাজনীতির রাস্তায় ছিল, আজও তাই আছে।” আর কিছু বলছি না। এবার আপনারাও মেলান অঙ্কটা। শেষ পর্যন্ত দেখা যায় কালীঘাটের আদিগঙ্গার জল বিধানসভা ভোটের আগে কতদূর গড়া। 
Share To:

kakdwip.com

Post A Comment:

0 comments so far,add yours