গ্রামের গরিব মানুষের কর্মসংস্থানের জন্য ২০০৫ সালে তৎকালীন ইউপিএ সরকার মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান গ্যারান্টি আইন পাশ করে। ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে এই আইন বাস্তবায়িত হয়। এই আইন অনুসারে একটি সংসার বছরে ১০০ দিন কাজ পাবে।
একশো দিনে কি বদলেছে গ্রাম বাংলার হাঁড়ির হাল?
একশো দিনের কাজের জেরে কতটা বদলেছে গ্রাম বাংলার অর্থনীতি?
মা, দুটো চাল দিও। ছেলে-মেয়েরা না খেয়ে বসে আছে।’ জীর্ণ শরীর। হাত দুটো বাড়িয়ে ভিক্ষা চাইল। কথাগুলো শুনে চোখ ছলছল করে উঠল বাড়ির গিন্নিমার। ছিন্ন জামা পরা ব্যক্তিকে দেখে মনে হল, সকাল থেকে সে-ও কিছু খায়নি। গিন্নিমা তাঁকে ঘরে বসালেন। খেতে দিলেন। কথায় কথায় গিন্নিমাকে ওই ব্যক্তি বললেন, আগে বিভিন্ন বাড়িতে কাজ করতেন। মাঠে ধান তুলতেন। দিনমজুরি করতেন। এখন আর তেমন কেউ কাজ দেয় না। তাই ভিক্ষা করছেন।
এতদূর পড়ে মনে হতে পারে কোনও গল্পের প্লট। সত্যিই কি তাই? ২০০৪ সালে এই বাংলারই ঝাড়গ্রামের আমলাশোলে অনাহারে মৃত্যুর খবর সংবাদের শিরোনামে উঠে এসেছিল। গ্রাম বাংলায় দু-বেলা দু’মুঠো খাবারের জন্য হা-পিত্যেশের ছবি আরও আছে। আর সেখান থেকেই মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান গ্যারান্টি আইনের ভাবনা। গ্রামের মানুষ যাতে বছরে ১০০ দিন কাজ পান, তাই শুরু হয় MGNREGA(মহাত্মা গান্ধী ন্যাশনাল রুরাল এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি অ্যাক্ট)। গ্রাম বাংলার মানুষের কাছে যা একশো দিনের কাজ হিসেবেই বেশি পরিচিত।
মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান গ্যারান্টি আইনের লক্ষ্য-
গ্রাম দিয়ে ‘ঘেরা’ আমাদের দেশ। ভারতের জনসংখ্যার প্রায় ৭০ শতাংশ বাস করেন গ্রামে। দারিদ্র, বেকারত্ব, কম আয়-এমন নানা সমস্যায় জর্জরিত গ্রাম বাংলার বহু মানুষ। গ্রামের গরিব মানুষের কর্মসংস্থানের জন্য ২০০৫ সালে তৎকালীন ইউপিএ সরকার মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান গ্যারান্টি আইন পাশ করে। ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে এই আইন বাস্তবায়িত হয়। এই আইন অনুসারে একটি পরিবার বছরে ১০০ দিন কাজ পাবে। অর্থাৎ কোনও পরিবারের ৫ জন প্রাপ্তবয়স্ক সদস্য MGNREGA-য় কাজ করলে সবাই মিলে তাঁরা বছরে একশো দিন কাজ করবেন। কাজের বিনিময়ে সরকার নির্ধারিত মজুরি পাবেন। কাজের স্থানে কর্মরত শ্রমিক আহত হলে, রাজ্য সরকার বিনামূল্যে তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে।
.
একশো দিনের কাজের মজুরি-
একশো দিনের কাজে তিন রকমের শ্রমিক কাজ করেন। দক্ষ শ্রমিক। যাঁদের দৈনিক মজুরি ৪৪৬ টাকা। অর্ধদক্ষ শ্রমিক। যাঁদের দৈনিক মজুরি ৩৩৪.৫০ টাকা। আর অদক্ষ শ্রমিক। যাঁদের দৈনিক মজুরি ২২৩ টাকা। এছাড়া একশো দিনের কাজে নজরদারির জন্য একজন সুপারভাইজার থাকেন। প্রতি ৫০ জন শ্রমিক পিছু একজন সুপারভাইজার। আর সেই সুপার ভাইজাররা দৈনিক ৩৪৪.৫০ টাকা পান।
একশো দিনের কাজে কী কী কাজ হয়?
পুকুর খনন ও সংস্কার। ভূগর্ভস্থ বাঁধ নির্মাণ। সেচ পুকুর খনন। মরা খাল খনন। মজা নদী খনন। ব্যক্তিমালিকাধীন পুকুরের জলধারণ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য সংস্কার (যদি মালিকপক্ষ গ্রাম পঞ্চায়েতের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে জনসাধারণকে বাড়তি জল ব্যবহার করতে রাজি হন)। পতিত জলাভূমি সংস্কার। সব ঋতুর উপযোগী গ্রামীণ সড়ক ব্যবস্থা। প্রধানমন্ত্রী গ্রামীণ সড়ক যোজনা প্রকল্পের রাস্তার মাটির কাজ।
একশো দিনের কাজ শুরু হওয়ার পর কতটা বদলেছে গ্রাম বাংলা?
গ্রাম-বাংলায় একটু ঘুরলেই একশো দিনের কাজের নানা ছবি ধরা পড়ে। কোথাও পুকুর কাটায় ব্যস্ত শ্রমিকরা। কোথাও রাস্তায় মাটি ফেলার কাজ চলছে। পশ্চিম মেদিনীপুরের দাসপুরের এক শ্রমিক বলেন, একশো দিনের কাজ আসার আগে আমরা দিনমজুরি করতাম। লোকের জমিতে কাজ করতাম। যতটা পরিশ্রম করতে হত, সেইমতো মজুরি মিলত না। একশো দিনের কাজ শুরু হওয়ার পর, সেইসব মজুরিও বাড়ে।
আর একজন বললেন, অনেক বাড়ির মেয়ে-বউরা অন্যের জমিতে হয়তো কাজ করতে যেতেন না। কিন্তু, তাঁরাও নির্দ্বিধায় একশো দিনের কাজ করছেন। একশো দিনের কাজে বিভিন্ন রকম শ্রমিক লাগে। পুকুর খননের কাজে পাড়ায় ঘুরে ঘুরে ছাই জোগাড় করে আনেন কেউ। ফলে একটু বয়স্ক মানুষও কাজ করতে পারেন। অন্যের জমিতে হয়তো কাজ করতে পারবেন না তিনি। করোনার পর ভিনরাজ্য থেকে ফিরে অনেকেই একশো দিনের কাজে যোগ দেন। সংসার চালাতে আঁকড়ে ধরেন একশো দিনের কাজকে।
একশো দিনের কাজের প্রশংসা করলেও উঠছে প্রশ্নও-
একশো দিনের কাজ শুরু হওয়ার পর দিনমজুর পাওয়ার সমস্যা বেড়েছে বলে অনেকে অভিযোগ করেন। তাঁদের বক্তব্য, অনেক শ্রমিকই এখন অন্যের জমিতে কাজ করতে চান না। কাজ করলেও নানা বায়নাক্কা করেন। কখনও কখনও অতিরিক্ত মজুরি চান। একশো দিনের কাজে দুর্নীতির অভিযোগও ওঠে ভূরি ভূরি। আর তা নিয়ে বর্তমানে রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকারের চাপানউতোর চলছে। একশো দিনের কাজের টাকা কেন্দ্র দিচ্ছে না বলে অভিযোগে সরব হয়েছে রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল। আবার বিজেপির অভিযোগ, একশো দিনের প্রকল্পের টাকা নিয়ে দুর্নীতি করছে রাজ্যের শাসকদল। লোকসভা ভোটের আগে রাজ্যে কর্মশ্রী প্রকল্প চালু করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জবকার্ড হোল্ডারদের বছর অন্তত ৫০ দিন কাজ দেওয়ার কথা বলা হয় কর্মশ্রী প্রকল্পে।
.
একশো দিনের কাজ আসায় গ্রাম বাংলার অর্থনীতির কি উন্নতি হয়েছে? কী বলছেন অর্থনীতিবিদরা?
একশো দিনের কাজের জেরে গ্রাম বাংলার মানুষ কতটা উপকৃত হয়েছেন? কতটা লাভবান হয়েছেন তাঁরা? প্রশ্ন শুনে অর্থনীতিবিদ তথা দুর্গাপুর মহিলা মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ মহানন্দা কাঞ্জিলাল বলেন, “দেশে এমজিএনআরইজিএ চালু হয়েছিল মূলত দারিদ্র দূরীকরণের লক্ষ্যে। এর মূল উদ্দেশ্যই ছিল গ্রামাঞ্চলে গরিব মানুষের রোজগারের ব্যবস্থা করা। বছরের ১০০ দিন কাজ দেওয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু, দুর্ভাগ্যজনকভাবে ধীরে ধীরে সরকারের তরফে দেখানো হয় যে, এটা যেন একটা চাকরি। আবার মানুষ একশো দিনও কাজ পাচ্ছেন না। এই প্রকল্পের গুরুত্ব আরও বেড়েছে করোনার পর। কোভিডের পর পরিযায়ী শ্রমিকরা গ্রামে ফিরে আসেন। সেইসময় একশো দিনের কাজের গুরুত্ব বেড়ে যায়। ফলে যেটা দারিদ্র দূরীকরণ কর্মসূচির অন্তর্গত ছিল, সেটা দুর্ভাগ্যজনকভাবে রোজগারের উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে সরকারের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। রোজগারের উপায় নেই বলে গ্রামের বহু মানুষ একশো দিনের কাজকে আঁকড়ে বেঁচে রয়েছেন। অথচ, অনেক সময় রাজ্য সরকার ঠিক সময় মতো কেন্দ্রের কাছ থেকে টাকা পাচ্ছে না। ফলে গরিব মানুষও সময়ে টাকা পাচ্ছেন না। ফলে তাঁরা সমস্যায় পড়ছেন। এই বিষয়টা দেখা দরকার সরকারের।”
একশো দিনের কাজকে কর্মসংস্থানের স্থায়ী উপায় হিসেবে দেখা উচিত নয় বলে মনে করেন তিনি। দুর্গাপুর মহিলা মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষের কথায়, “আমি বারবার বলি, একশো দিনের কাজ কখনওই কর্মসংস্থানের স্থায়ী উপায় হতে পারে না। কর্মসংস্থান নিয়ে কেন্দ্র ও রাজ্যকে ভাবতে হবে। এর জন্য কলকারখানা করতে হবে। বৃহৎ শিল্প দরকার। না হলে একসঙ্গে বহু মানুষকে কর্মসংস্থান দেওয়া যায় না। সেটা ভারতে অভাব। সেজন্য একশো দিনের কাজের উপর মানুষের নির্ভরশীলতা বেড়েছে।”
তবে একশো দিনের কাজের ব্যর্থতা খুঁজতে নারাজ তিনি। বরং বললেন, “এই প্রকল্পের জেরে একেবারে দরিদ্র মানুষের হাতে কিছু টাকা আসছে। এটা এই প্রকল্পের সাফল্য। তবে অর্থনীতির জন্য এটা ভাল নয়। কৃষিকে লাভজনক না করতে পারলে গ্রামের মানুষের উন্নতি সম্ভব নয়।”
অর্থনীতিবিদ প্রসেনজিৎ বসু বলেন, “আমাদের দেশে গ্রামাঞ্চলে বেকারত্বের বিশাল সমস্যা রয়েছে। সেই কারণেই MGNREGA আনা হয়েছে। এতে মানুষ অনেকটাই উপকৃত হয়েছে। তাই ২০১৪ সালে নতুন সরকার আসার পর এই প্রকল্প না সরিয়ে বরং বরাদ্দ বাড়িয়েছে।”
লোকসভা ভোটের আগে অন্তর্বর্তী বাজেটে ২০২৪-২৫ আর্থিক বছরের জন্য একশো দিনের কাজের প্রকল্পে ৮৬ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে কেন্দ্র। যে ব্যক্তি নিজের সন্তানদের মুখে অন্ন তুলে দিতে অন্যের বাড়িতে ভিক্ষার ঝুলি পেতে দিয়েছিলেন, তিনি কি আজ একশো দিনের কাজ করেন? তাঁর সন্তানরা কি আজ অভুক্ত থাকে না? গ্রাম বাংলার অর্থনীতিতে কি বদল এসেছে? উত্তর খোঁজা চলবেই। যুক্তি-পাল্টা যুক্তি থাকবে। তার মাঝেই মাথায় ঝুড়ি নিয়ে একশো দিনের কাজে যোগ দেবেন গ্রামের দরিদ্র পরিবারের সদস্যরা। দু’মুঠো অন্নের সংস্থানই যাঁদের মুখে হাসি ফোটায়।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours