১৯৪৩। স্বৈরাচারী একনায়ক মুসোলিনির পতনের পর ইতালির তখন নাৎসি জার্মানির হাতে। সেখানেও নাৎসিদের ইহুদি নিধন যজ্ঞের হাত থেকে রেহাই পেলেন না ইতালিতে বসবাসকারী ইহুদিরাও। নাৎসিদের অত্যাচারে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল একের পর এক ইহুদি পরিবার। সেই সময়ে ইহুদি হওয়ার কারণে নাৎসিদের হাতে গ্রেফতার হওয়া ড্যানিয়েল ইস্রায়েল নির্বাসিত হয়েছিলেন আউশভিৎসে। নির্বাসনের আগে কয়েক মাস ত্রিয়েস্তে শহরের জেলে বন্দি ছিলেন তিনি। সেখান থেকেই তাঁর দুই ছেলে এবং স্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে প্রায় আড়াইশোটি চিঠি লিখেছিলেন তিনি। পরবর্তীকালে সেই চিঠিগুলি এসেছিল প্রকাশ্যে। যেন আঁকা হয়ে ছিল হলোকাস্টের কারণে ছিন্নবিচ্ছিন্ন একটি পরিবারের গভীর চলমান প্রতিকৃতি।

কিন্তু নাৎসিদের জেলে বন্দি থাকা অবস্থায় কড়া পাহারা এড়িয়ে পরিবারের সঙ্গে চিঠি লিখে যোগাযোগ করা ছিল একপ্রকার অসম্ভব। কীভাবে সম্ভব হয়েছিল এই আশ্চর্য ঘটনা? সেই বিষয়ে বলতে গিয়ে তাঁর পুত্র দারিও ইস্রায়েল জানিয়েছেন, তাঁর বাবা আসবাবপত্রের গদি সেলাই করার কাজে অসম্ভব পারদর্শী ছিলেন। বর্তমানে ৮৫ বছর বয়সে দারিওর স্মৃতি একটু টাল খেলেও, বাবার সব স্মৃতিই অটুট তাঁর মনে। দারিওর থেকে বছরখানেকের ছোটো ভাই ভিটোরিওর মতেও, তাঁদের বাবার জন্য সেলাই ছিল জলের মতোই সহজ ব্যাপার।

ত্রিয়েস্তের কারাগারের অন্ধ কূপ থেকে বাইরের শহরে চিঠি পাঠানোর জন্য অভূতপূর্ব পন্থা নিয়েছিলেন ড্যানিয়েল। কারাগারে বন্দিদের জামাকাপড় সাফসুতরো করার জন্য নিয়মিত সেগুলি সংগ্রহ করে নেওয়া হত। ড্যানিয়েলেরই গৃহসজ্জার দোকানের দু’জন প্রাক্তন অ-ইহুদি কর্মচারী নিযুক্ত ছিলেন এই কাজে। তাঁদের সঙ্গে যোগসাজশ করেই এই চিঠি চালাচালির কাজটি সম্ভব হয়েছিল ড্যানিয়েলের পক্ষে। নিজের অপরিষ্কার জামার কলার এবং হাতার কাপড়ের ভিতরে চিঠির কাগজ ভরে নিখুঁতভাবে সেগুলি সেলাই করে দিতেন ড্যানিয়েল। এরপর তাঁর প্রাক্তন কর্মচারীরা সেই জামা পৌঁছে দিত দুই শিশুপুত্রকে নিয়ে লুকিয়ে থাকা তাঁর স্ত্রী আনার গোপন ঠিকানায়। বলাবাহুল্য, এই কাজে ঝুঁকি ছিল অপরিসীম। কিন্তু সন্তান স্নেহে কাতর পিতার কাছে ঝুঁকি কবেই বা খুব বড় ব্যাপার ছিল!

দারিও এবং ভিটোরিও দু’জনেই জানিয়েছেন, তাঁদের পরিষ্কার মনে আছে কীভাবে চিঠিগুলো তাঁদের হাতে পৌঁছোত। “আমরা রীতিমতো অপেক্ষা করতাম বাবার চিঠি পাওয়ার জন্য। বাবার নোংরা জামাকাপড় মায়ের হাতে পড়লেই, সবার আগে গলার এবং হাতার সেলাই খুলে চিঠিগুলো বের করে নেওয়া হত। তারপর চিঠির উত্তর আলাদা চিঠিতে লিখে সেইভাবেই পাঠিয়ে দেওয়া হত ড্যানিয়েল-এর কাছে।” চিঠির কোনো-কোনো অক্ষর ঝাপসা হয়ে যেত কি আনার চোখের জলে? জানা হয় না।

কী লেখা থাকত ড্যানিয়েলের পাঠানো চিঠিতে? তাঁরা জানাচ্ছেন, বেশিরভাগ সময়ই ছেলেদের খবরাখবর এবং কুশল সংবাদ ভরা থাকত চিঠির প্রতিটি অক্ষরে। চিঠির বক্তব্যে পরিষ্কার হয়ে উঠত যে, ঠিক কতটা ভয় এবং বিভীষিকার মধ্যে তিনি রয়েছেন জেলে। যদিও ড্যানিয়েল সবসময় ভাবতেন সবকিছু শান্ত হয়ে যাবে। আনার মা-বাবা অর্থাৎ ড্যানিয়েলের শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে একই দিনে নাৎসি বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন ড্যানিয়েল। কোনোভাবে তাঁর ছেলেরা এবং আনা গোপনে পালিয়ে আসেন ত্রিয়েস্তের একটি লুকনো আস্তানায়।

ড্যানিয়েলের চিঠিতে ধরা পড়েছে কারাগারের কুঠুরির ছবিও। "আলো, জল আর জানালাবিহীন একটা ঘর। ছাদে কেবল একটি ছোট্ট স্কাইলাইট। শৌচাগার অবধি নেই। মাঝেমাঝে জার্মানদের হাসাহাসি শুনতে পাই, যে আমরা নাকি পোলা [বর্তমানে ক্রোয়েশিয়ার পুলা] থেকে উদ্বাস্তুর দল, যাদের বাড়িতে আমেরিকানরা বোমা মেরেছে।"

ওই সময়েই জার্মান কর্তৃপক্ষ নিয়মিতভাবে ড্যানিয়েলের উপর চাপ দিয়ে চলেছিল তাঁর স্ত্রী এবং পুত্রদের লুকনো আস্তানার খবর দেওয়ার জন্য। ড্যানিয়েল শুধু বলে চলেছিলেন যে, তাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগই নেই তাঁর। যদিও দুঃখের বিষয়, ড্যানিয়েলের প্রায় ২৫০টি চিঠি আনা সংরক্ষণ করে থাকলেও, আনার লেখা চিঠি চিঠিগুলির একটিও উদ্ধারের সম্ভাবনা ছিল না। "বাবা সেগুলি পড়তেন এবং সঙ্গে সঙ্গে লোপাট করে ফেলতেন। জার্মানদের হাতে ধরা পড়লে সর্বনাশ কাণ্ড হত! ঈশ্বর মঙ্গলময়!"

চিঠিতে ধরা পড়েছে, মাঝেমাঝেই কারাগার থেকে অন্য বন্দিদের চলে যেতে দেখে মনখারাপ হয়ে যেত ড্যানিয়েলের। হতাশ হয়ে তিনি ভাবতেন, সবার ছুটি হয়ে গেলেও তাঁর ছুটি কবে হবে? তিনি বুঝতে পারেননি, যে তাঁরা আসলে চলেছে তাঁদের মৃত্যুর দিকে! কিন্তু ১৯৪৪ সালের ২ সেপ্টেম্বর ড্যানিয়েল ও তার শ্বশুর-শাশুড়িকে আউশভিৎসের ট্রেনে তুলে দেওয়ার পরেই কঠোর সত্যিটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল তাঁর কাছে। “সেই সময় বাবার একটি চিঠি আসে, যাতে তিনি লিখেছিলেন, 'দূর থেকে ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে। ট্রেনের ধোঁয়ার থেকে বেশি কিছু। তীব্র ধোঁয়াশা। এটা নরক!"

দারিও-ভিটোরিও জানেন যে, তাদের দাদু-দিদা আউশভিৎসে মারা গিয়েছিলেন। কিন্তু ড্যানিয়েলের কী হয়েছিল কখনোই আর জানা যায়নি সেটা। যুদ্ধ শেষে তাঁরা শুনেছিলেন যে, শিবিরটি মুক্ত হওয়ার দুই সপ্তাহ আগেও তাঁকে জীবিত দেখা গিয়েছিল। দারিও জানান, তাঁদের মা বছরের পর বছর ধরে রেডক্রসের মাধ্যমে, কখনও কখনও নিজে থেকেই নাছোড় অনুসন্ধান করেছিলেন। যদিও তাঁরা দু’জনেই মনে করেন যে, সেই সময় জার্মানরা হাজার হাজার আউশভিৎসের বন্দিকে আরও পশ্চিমে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করার সময়ই হয়তো মারা গিয়েছিলেন তাঁদের বাবা।

"যুদ্ধের পরে আমরা চলে এসেছিলাম ইটালির ভিয়া গিয়ুলিয়ার বাড়িতে। কিন্তু ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত এখানে থাকার পর মা শেষ পর্যন্ত আশা ছেড়ে দিলেন এবং দেশত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কারণ বাবা লিখেছিলেন যে, তিনি ফিরে না আসলে আমাদের অবশ্যই প্যালেস্টাইনে চলে যাওয়া উচিৎ”— স্মৃতির পাতায় দগদগে ক্ষতের দাগ স্পষ্ট হয়ে ওঠে ভিটোরিওর কথায়।

ইতালি থেকে বের হওয়ার সময় তাঁর স্বামীর কাছ থেকে পাওয়া চিঠির সংগ্রহটি সঙ্গে নিয়েছিলেন আনা। নিজস্ব ব্যক্তিগত সিন্দুকে পরম মমতায় রাখা ছিল স্বামীর হাতের অক্ষর। ১২ বছর আগে, ৯৬ বছর বয়সে আনা মারা যাওয়ার পরে তেল আভিভে তাঁর অ্যাপার্টমেন্টটি পরিষ্কার করার সময় খুঁজে পাওয়া যায় সেটি।

চিঠিগুলি কেবলমাত্র পারিবারিক সম্পত্তি হিসাবেই থেকে যেত, যদি না সম্প্রতি একদল গবেষকের সঙ্গে সাক্ষাৎ না হয়ে যেত দারিও-ভিটোরিওর। হারিয়ে যাওয়া ইহুদিদের সন্ধানের চেষ্টা করছিলেন সেই দলটি। সেই দলের পক্ষে এলিজাবেথ নামের এক গবেষকের কথায়, ড্যানিয়েল তাঁর কারাবাসের সময় প্রতিদিন গড়ে একটি করে চিঠি লিখেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সমস্ত ইহুদিরা যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গিয়েছিল, সেই আবেগের জীবন্ত দলিল চিঠিগুলি। তাঁর কথায়, “প্রথমে ড্যানিয়েল বুঝতেই পারছেন না কেন তিনি কারাগারে আছেন? ভাবছেন যে, নিশ্চই কোথাও কিছু ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে, সব ঠিক হয়ে যাবে। তারপরে বাড়তে থাকে ড্যানিয়েলের রাগ, বিরক্তি, হতাশা, ভয়।”

এলিজাবেথ এবং তাঁর সহকর্মীরা গবেষণার জন্য অনুবাদ এবং অনুলিপি করেছিলেন সমস্ত চিঠির। মূল চিঠিগুলি এখন রাখা আছে জেরুজালেমের ওয়ার্ল্ড হলোকাস্ট রিমেমব্রান্স সেন্টারে, হিংস্র শাসকের বিপরীতে দাঁড়িয়ে স্নেহশীল পিতার ভালবাসার বর্ণমালা বুকে নিয়ে।

Share To:

kakdwip.com

Post A Comment:

0 comments so far,add yours